গোয়েল সাহেব আমাদের ব্যাঙ্কের রিজনাল ম্যানেজার — বড়ো সাহেব। উনি বসে আছেন নিজের অফিসে। পিওন গিয়ে তার সামনে হেড অফিসের আর জোনাল অফিসের ডাক, চিঠিপত্র রেখে এসেছে। সকাল সকাল উনি খাম খুলে বিশেষ চিঠিগুলি পড়েন আর তারপরে যে বিভাগের সম্বন্ধিত চিঠি, সেই বিভাগে পাঠিয়ে দেন। একটা সরু কাঠের ছুরি দিয়ে সাবধানে সব খামগুলি খোলেন। সেইদিনও এই ভাবেই খাম খুলে চিঠি পড়ছিলেন। সব চিঠি পড়ে উনি পিওনকে ডেকে বিতরণ করার জন্য দিয়ে দিলেন।
তারপরে একটা ম্যাগাজিন খুলে পাতা পাল্টে ছবি দেখলেন, আর কিছু পড়ে ড্রাইভারকে ডাকার জন্য ঘণ্টি। বাজালেন। ড্রাইভারের নাম রাম প্রসাদ। পিওনকে বললেন রাম প্রসাদকে ডেকে আনতে। রাম প্রসাদ হাজির হল। তাকে সেই ম্যাগাজিনটা দিয়ে বললেন “যাও, য়ে মেমসাহেবকো ঘর পে দে আও।”
আমরা সবাই নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছি। রাম প্রসাদ প্রায় এক ঘণ্টা পড়ে ফিরে এলো। এসে সোজা সাহেবের ঘরে গিয়ে জানালো যে সে ম্যাগাজিনটা পৌঁছে দিয়ে এসেছে। আর তার সাথে মেমসাহেব একটা পর্চি পাঠিয়েছে। গোয়েল সাহেব পর্চিটা পড়ে রাম প্রসাদকে একটা ৫০০ টাকার নোট দিয়ে বললেন “যাও সামান লে লো আউর ঘর পড় দে আও।”
এবার একটু গোয়েল সাহেবের পরিচয় করিয়েদি আপনাদের। আগেই বলেছি গোয়েল সাহেব এক বড়ো অফিসার। ওনার অনেক ক্ষমতা। উনি দোষ কোটি টাকার লোন চুটকি বাজিয়ে দিতে পারেন। ব্যাঙ্ক থেকে তাকে ড্রাইভার সহ গাড়ী দিয়েছে। ওনার বয়েস হবে প্রায় ৫৮। একটু শ্যামলা বরণ, আর একটু মোটা ধাঁচের শরীর। বলা বাহুল্য ওনার পেট সব সময়ে বেড়িয়ে থাকে, অনেকটা ওই ঘড়ার মতো। উনি বিয়ার খেতে খুব ভালবাসেন। শুধু ভালবাসেন না, একটু অধিক মাত্রায় আছে ওনার বিয়ারের প্রতি ভালোবাসা। তাই বোধ হয় পেটটা ঐরকম ঘড়া মার্কা। মাথায় টাক পড়ে গিয়েছে, কেবল তিন পাশে ঝালরের মতো কিছু চুল ঝুলছে যাকে তিনি খুব যত্ন সহকারে আঁচড়ান। পকেট থেকে মাঝে মাঝে একটা ছোট চিরুনি বার করে আঁচড়ে নেন। দিনে সাত-আঠ বার তো হবে নিশ্চয়ই। আমরা ওনাকে আড়ালে কেউ ‘টাকলু’ বা কেউ ‘গোলু’ বলে ডাকি। ভালবেসে আমরা যাই ডাকিনা কেন বস তো শেষে বস হচ্ছেন। কে জানে শুনতে পারলে আবার রেগে দূরে বিদঘুটে জায়গায় কোন ব্রাঞ্চে পোস্টিং না করে দেন।
রাম প্রসাদ বড়ো সাহেবের ড্রাইভার। বড়ো সাহেবের ড্রাইভারকেও বড়ো মনে করা হয়। যখন সাহেবেকে নিয়ে ব্রাঞ্চে যায়, তখন ব্রাঞ্চ ম্যানেজাররা ড্রাইভারেরও ভালোই খাতির করে। রাম প্রসাদ রোজ সকালে সাইকেল করে সাহেবের বাড়ী যায়। প্রথমে গাড়ীটা পরিষ্কার করে। মেমসাহেব রোজ রাম প্রসাদকে চা দেন যতক্ষণে সাহেব তৈরি হচ্ছেন। তারপরে সাহেবের ব্রীফকেস নিয়ে গাড়ীতে রাখেরাম প্রসাদ। এছাড়া বাড়ির ছোটখাটো নানা কাজ করেই রাম প্রসাদ।
একদিন রাম প্রসাদকে কাছে ডেকে বলি “ক্যা ড্রাইভার সাহেব, কভি হামারে সাথ ভি চায় পিয়া করো। অফিস কি চায় আচ্ছি নাহিঁ হ্যায় ক্যা? ইয়া খালি মেমসাহেব কে হাথ কি হি পিনা হ্যায়?” রাম প্রসাদ একটু লাজুক ভাবে বলল “সাহেব হাম তো সেবক হ্যায়, আপ পিলায়েঙ্গে তো পি লেঙ্গে।” চা খেতে খেতে ধীরে করে জিজ্ঞাসা করলাম সাহেবের আজকে মুড ঠিক নেই কেন? রাম প্রসাদ বলল যে কাল রাত্রে গোয়েল সাহেব নতুন ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিলেন। সেই ফ্যাক্টরি আমাদের ব্যাঙ্কে লোনের জন্য আবেদন করেছে। ফেরার পথে ফরচুন হোটেলে ডিনার করে ফিরেছেন। আমি বললাম সেতো বটেই সাহেব কি রাত্রে যে কোন জায়গায় ডিনার করবেন নাকি? বড়ো হোটেলে যেতেই হবে। রাম প্রসাদ জানালো যে কাল রাত্রে নাকি মদের মাত্রাটা একটু বেশী হয়ে যায়। রাত্রে ফিরতে ফিরতে এগারোটা বেজে যায়। আজ সকালে উঠে সাহেব মেমসাহেবের কাছে লেবু-জল চায় নেশাটা দূর করার জন্য। তাতে মেমসাহেব রেগে যান আর গোয়েল সাহেবকে অনেক কথা শুনিয়ে দেন — বয়েস হচ্ছে, পেট বেড়ে যাচ্ছে, ওজন আরও অধিক মাত্রায় বাড়ছে, সাথে আবার ডাইয়াবিটিস আছে, তবুও মদ দেখলে আর লোভ সামলাতে পারেনা, ইত্যাদি। তাই সকাল সকাল সাহেবের মুড খারাপ।
সপ্তাহ খানেক পরে, এক সোমবারে আবার ডাকি রাম প্রসাদকে একসাথে চা খাবার জন্য। চা খেতে খেতে আবার জিজ্ঞেস করি কি ব্যাপার আজকে সাহেবের মুড খুব ভালো দেখছি। মনে হচ্ছে সাহেব তারপরে আর মেমসাহেবের কাছে বকা খাননি। রাম প্রসাদ জানালো যে কাল রাত্রে আবার সেই পার্টির ওখানে ডিনার ছিল। ফেরার পথে সাহেবকে কয়েকটা বাক্স দ্যায়। তার মধ্যে একটা মনে হয় মেমসাহেবের জন্য গয়নার বাক্স। বাকি মনে হয় মিষ্টির আর কাজু-বাদামের হবে। তাই সাহেব আর মেমসাহেবের দুইজনের মুড খুব ভালো আজকে। জিজ্ঞাসা করলাম রাম প্রসাদকে ও কি পেলো? ও বলল ওকে শার্ট আর প্যান্টের কাপড় দিয়েছে সাথে এক বাক্স মিষ্টি। আমি বললাম “ফিরতো তুম ভি খুশ!” রাম প্রসাদ হেসে চা শেষ করে চলে গেলো।
বড়ো সাহেবকে খুশ করতে গেলে তার সাথে তার ড্রাইভারকেও খুশ রাখতে হয়। অবশ্য ড্রাইভারকে খুশ রাখলে মাঝে মাঝে অনেক হাঁড়ির খবরও পাওয়া যায়। 🙂
