লকার কাণ্ড

রবিবার সকালে প্রাতঃরাশ সারতে সারতে দত্তবাবু চিন্তা করলেন যে সেদিন নিজের খাজানা চেক করবেন। নিজের সেই ছোট আলমারি খুলে সব ব্যাঙ্কের পাসবুক, ফিক্সড ডিপসিটের রসিদ, বিকাস পত্র, জীবন বীমার পলিসি ইত্যাদি বার করে সব মাটিতে ছড়িয়ে ফেললেন। তারপর সব আলাদা করে একটার উপর একটা আলাদা আলাদা করে সাজালেন।

দত্তগিন্নী দরজার ফাঁক গিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন দত্তবাবু হটাৎ কিসে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন।  তার ওই অবস্থা দেখে দত্তগিন্নী বললেন — “ওঃ তুমি দেখি এখন যেভাবে ব্যাস্ত আছো তোমার লাঞ্চ খেতে খেতে তো দেখছি দুটো বেজে যাবে। তাহলে যাই আমি পাশের বাড়ির বৌদির সাথে একটু আড্ডা মেরে আসি।” 

— “যাও, যাও তোমাদের দুইজনের আর কি কাজ? খালি পতি-নিন্দা আর হাহা-হিহি করা।” 

— “তুমি কি আমাদের হাসিটাও বন্ধ করতে চাও নাকি? আর তোমাদের প্রশংসাটাই বা কিসের আছে?” বলে বেড়িয়ে গেলেন দত্তগিন্নী। 

পুরানো পাসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে ওনার চোখ পড়লো মেয়ের এক পুরানো পাসবুকে। পুরো আপডেট নেই। মেয়ে বিয়ে হয়ে যাবার পরে আর এই অ্যাকাউন্ট নেড়ে দেখেন নি। ভাবলেন আগামী কাল সোমবারে ব্যাঙ্কে গিয়ে আপডেট করে আনবেন। আর যখন প্রয়োজন নেই তো অ্যাকাউন্টটা বন্ধ করে দেবার জন্য আবেদন করে আসবেন ব্যাঙ্কে। অবসরপ্রাপ্ত মানুষ কোন কাজ পেলে খুব খুশী হয়। 

সোমবার সকালে জলখাবার খেয়ে ব্যাঙ্কে গেলেন দত্তবাবু মেয়ের পাসবুক আপডেট করাতে আর অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার আবেদন দিতে। টেলারের কাছ থেকে পাসবুক আপডেট করে গেলেন সেভিং অফিসার দাসবাবুর কাছে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার আবেদন দিতে। দাসবাবু অ্যাকাউন্ট চেক করে জানালেন যে লকারের ভাড়া কাটছে প্রতি বছর ওই অ্যাকাউন্ট থেকে, তাই লকার সারেন্ডার না করলে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা যাবেনা। 

দত্তবাবু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন — “দেখুন আমাদের তো এই ব্যাঙ্কে কোন লকার নেই। একটা ছিল তা সে প্রায় চার বছর আগে মেয়ের বিয়ের সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। চাবি ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হয়েছিলো। লকারের আর প্রয়োজন নেই বলে।” 

দাসবাবু বললেন — “508 নম্বর লকার আছে আপনাদের নামে। যান আগে লকারের চাবি নিয়ে আসুন। লকার খালি করে দিন, তারপরে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা যাবে।” 

বাড়ীতে ফিরে দত্তবাবু পুরো বাড়ী খুঁজলেন কিন্তু লকারের চাবি কোথাও খুঁজে পেলেননা। গিন্নীকেও জিজ্ঞাসা করলেন। দত্তগিন্নী বললেন — “ব্যাঙ্কের লকারের চাবি তো আমরা ফেরৎ দিয়ে দিয়েছিলাম ৪ বছর আগে… ওই ঠিক বিয়ের আগে। মেয়ের বিয়ের জন্য গয়না করছিলাম তাই রাখার জন্য লকার নেওয়া হয়েছিলো। বিয়ের আগে খালি করে আমরা নিয়ে এসেছিলাম আর প্রয়োজন হয়নি। আমার যা দুএকটা গয়না আছে তা তো বাড়ির আলমারির লকারেই রাখা আছে। ব্যাঙ্ক কেন যে বলছে আমি বাবু বুঝতে পারছিনা।” 

সেই রাত্রে মেয়েকে ফোন করা হোল। মেয়ে বলল — “আমার কাছে কোন চাবি-টাবি নেই। যা ছিল লকারে তা তো 4 বছর আগেই নিয়ে আসা হয়েছিলো। যদি অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা পড়ে থাকে তা আমাকে পাঠিয়ে দিও, প্লীজ বাবা।” 

অগত্যা, দত্তবাবু ব্যাঙ্কে গিয়ে আবার দাসবাবুকে বললেন যে বাড়ীতে কোন চাবি নেই আর সবার একই কথা যে চাবি ব্যাঙ্কে ফেরৎ দেওয়া হয়েছে 4 বছর আগে। দাসবাবু আবার কম্পিউটারে ভালো করে দেখে বললেন — “আপনাদের এই 508 নম্বর লকারটা গত দু’বছরে তিনবার অপারেট হয়েছে আর প্রতি বছর আপনার এই অ্যাকাউন্ট থেকে ভাড়াও কাটাও হচ্ছে। আরে মশাই, কম্পিউটারে এমনই এন্ট্রি হয়ে যায় নাকি? যান আপনার স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে আসুন লকার খোলাতে, দেখবেন ঠিক মরে পড়ে গিয়েছে।” 

দিন দশেক পরে দত্তবাবু সস্ত্রীক ব্যাঙ্কে পৌঁছালেন। দত্তগিন্নী বললেন — “লকার আমাদের এই ব্যাঙ্কেই ছিল। তবে গত চার বছর আগে মেয়ের বিয়ের সময় আমরা লকার খালি করে দি। তারপরে আর প্রয়োজন পড়েনি আর আমরা আসিওনি। এমনকি পাসবুক পর্যন্ত আপডেট করানো হয়নি। আমার তো যা মনে পড়ছে আমরা লকার খালি করে ব্যাঙ্কে চাবি দিয়ে দিয়েছিলাম।” 

দাসবাবু বললেন — “তবে হয়তো আপনার মেয়ে এসেছিলেন। ওনাকে ডেকে নিয়ে আসুন। কনফার্ম হয়ে যাবে।” 

শ্রীমতী দত্ত বললেন — “মেয়ে এখানে থাকেনা। এখান থেকে অনেক দূরে থাকে। আর ওর কাছে সময় কই এখানে আসার? আমরাই মেয়ের কাছে যাই মাঝে-সাঝে। মেয়ে আসতে পারবেনা।” 

দাসবাবু বললেন — “অগত্যা আমাদের লকারের তালা ভাঙতে হবে। কোম্পানিকে খবর দিতে হবে। ওদের লোক এসে তালা ভাঙবে। সেই সময় আপনাদের খবর দেওয়া হবে। লকারের তালা আপনাদের সামনেই ভাঙ্গা হবে। যা খর্চা হবে তা আপনাদের অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নেওয়া হবে।” 

দত্তবাবু বললেন — “যখন নিরুপায় তখন আর কি করা যাবে? ব্যাবস্থা করুন তবে  লকারের তালা ভাঙ্গার।”

প্রায় দিন পনেরো পরে লকারের তালা ভাঙ্গা হোল। ভিতর থেকে তিনটে পুঁটলি বের হোল। দত্তগিন্নী তাড়াতাড়ি তিনটে পুঁটলি খুললেন। দেখেই আঁতকে উঠলেন আর চেঁচিয়ে বললেন — “এই জিনিসগুলো আমাদের নয়।” লকার অফিসারের মুখ তখন ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। চীফ ম্যানেজার মুখার্জী সাহেবও এসে গেছেন চিৎকার শুনে। ব্যাপারটা দেখে আরও কয়েকজন স্টাফ কৌতূহলে এসে গিয়েছে। মুখার্জী সাহেব ওনাদের নিজের অফিসে নিয়ে গেলেন। জল খাওয়ালেন প্রথমে। চায়ের অর্ডার দিলেন সাথে সাথেই। 

পুঁটলিগুলোর মধ্যে প্রায় 15-20 লাখ টাকার জিনিস আছে। কিন্তু দত্ত দম্পতি স্বীকার করলেন না যে ওই জিনিসগুলো ওনাদের। এই এতো সম্পত্তির মালিক কে তবে? লকার অফিসারের মুখ ফ্যাকাসে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে আছে। সবাই হতবাক। স্টাফেদের মধ্যে মৃদুস্বরে এই নিয়ে নানা আলোচনা, কানাফুসি চলছে। কেউ বলছে আজকেই সাসপেন্ড হয়ে যাবে, আবার কেউ বলছে পুলিস কেস হতে পারে… আরও কতো কি টিপ্পনী, মন্তব্য। ৪ বছর আগের ওরিজিনাল ডকুমেন্ট চাই, সত্য যাচাই করতে হবে। সব কাজ কম্পিউটারে হয়ে যাওয়ায় এখন পুরানো ডকুমেন্ট খুঁজে পাওয়াটা এখন একটু কষ্টকর। 

মুখার্জী সাহেব দফতরীকে আদেশ দিয়েছেন অরিজিনাল ডকুমেন্ট খুব শীঘ্র বার করতে। আজকে কারোর ছুটি নেই। ডকুমেন্ট আগে চাই। সব পিওন লেগে গিয়েছে সাহায্য করতে। প্রায় সাড়ে ছয়টার নাগাদ পাওয়া গিয়েছে। অরিজিনাল ডকুমেন্ট অনুযায়ী দত্তবাবুরা ঠিক বলছেন। ওনারা 4 বছর আগেই লকার সারেন্ডার করে দিয়েছিলেন। চাবিও ব্যাঙ্কে জমা করে দিয়েছিলেন। 

ইতিমধ্যে সেই লকার নাম্বার 508 রমাশীষ সেন নামক এক কাস্টমারকে এলট করা হয়েছে। কিন্তু রেকর্ড ডিজিটাইজেশনের সময় কম্পিউটারে ভুল বশত দত্তবাবুদের নাম আর অ্যাকাউন্ট নাম্বার রেকর্ড হরে যায়। লকারের ভাড়াও দত্তবাবুদের অ্যাকাউন্ট থেকে রীতিমতো কাটা হচ্ছে প্রতি বছর। সেন মহাশয়ের অ্যাকাউন্ট থেকে কোন ভাড়া কাটা হয়নি। মুখার্জী সাহেব তখনি এক পিওনকে দৌড় করালেন সেন মহাশয়কে ডেকে আনার জন্য। ব্যাঙ্কে সবাই এখন সেন মহাশয়ের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করছে। সেন মহাশয় সংবাদ পাওয়া মাত্র সপরিবারে ব্রাঞ্চে ছুটে আসেন আর ব্যাঙ্কের উপর চিৎকার করতে শুরু করেন। পুলিস ডাকার হুমকি দিলেন। এই দেখে ঘাবড়ে দত্তবাবু অজ্ঞান হয়ে পরে গেলেন। এ আবার আরেক মুশকিল হোল! মুখার্জী সাহেব তাড়াতাড়ি এক অফিসারকে দিয়ে নিজের গাড়ীতে নিকটস্থ এক নার্সিং হোমে পাঠিয়ে দিলেন দত্তদের। 

ধীরে-ধীরে সেন মহাশয় একটু ঠাণ্ডা হলেন। হয়তো দত্তবাবুর অবস্থা দেখে ওনার একটু সহানুভূতি হয়। মুখার্জী সাহেব এবং অন্য ম্যানেজারদের কথায় সেন পরিবার রাজী হোল সব ঠিক আছে কিনা চেক করতে। দেখা গেলো কোন জিনিসের গোলমাল নেই। সব ওনাদের হিসেব মতোই আছে। তখন রাত দশটা। আবার জিনিসগুলো লকারে রাখা হোল। সবাই খুশী হয়ে হ্যান্ডশেক করে নিজে নিজের বাড়ী ফিরলো। পরের দিন ব্যাঙ্কে মা কালীর প্রসাদ বিতরণ করা হয়েছিলো। আপনিও বোধহয়ে পেয়েছিলেন সেইদিন! 

দত্তবাবুর মধ্যরাত্রে জ্ঞান ফিরেছে। ব্লাড প্রেশার স্বাবাভিক মাত্রা থেকে নেমে গিয়েছিলো বলে উনি সম্বিৎ হারান। সত্যি, সৎমানুষ এখনো আছে এই পৃথিবীতে।

I'd love to hear your thoughts on this post! Please leave a comment below and let's discuss.