কালিকা শক্তিপীঠ শ্রী নলাটেশ্বরী মন্দির | নলহাটি

জাগ্রতা এবং আমি ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগানার দুমকা শহরে গিয়েছিলাম। আমরা সেখান থেকে প্রায় 70 কিলোমিটার দূরে তারাপীঠ মন্দির যাই মায়ের দর্শন করতে। সেবার ভোগ নিবেদনের পরিকল্পনা করেছিলাম। ভোগের পরে আমি বিকেলে আরেকটি শক্তিপীঠ নলাটেশ্বরী মন্দির দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। তারাপীঠ থেকে এটি প্রায় 25 কিমি দূরে। এক দিনে দুটি শক্তিপীঠ পরিদর্শন এবং প্রণাম করার একটি বিরল সুযোগ আমি মিস করতে চাইনি।

কথিত আছে, এখানে সতীর গলার নলি পড়েছিল। নলাটেশ্বরী থেকেই এলাকার নাম নলহাটি। সাধক স্মরনাথই এই জায়গা আবিষ্কার করে দেবীর নিত্যপুজার ব্যবস্থা ও মাহাত্ম্য প্রচার করেন। ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম বীরভূমের নলহাটির নলাটেশ্বরী মন্দির।

এবার পুরাণ কথিত সতীপীঠ নলাটেশ্বরীর কথা। বীরভূমের নলহাটী শহরের মধ্যভাগে অবস্থিত। দক্ষযজ্ঞের পর দেবী পার্বতীর শ্বাসনালী সহ কণ্ঠনালী এখানে পড়েছিল বলে প্রচারিত। বলা হয় কামদেব স্বপ্নাদেশ পেয়ে সতীর সেই কণ্ঠনালী উদ্ধার করেন। ব্রাহ্মণী নদীর তীরে ললাট পাহাড়ের নিচে দেবীর বেদী প্রতিষ্ঠিত হয়। নাম হয় দেবী নলাটেশ্বরী। পরে প্রতিষ্ঠিত হয় মন্দির। দেবী এখানে কালিকা রূপে পূজিত হন। আর ভৈরব এখানে যোগেশ। পুরাণ বিশেষজ্ঞদের মতে তন্ত্রে উল্লিখিত নলাপাত থেকে এই নলাটেশ্বরী নামটি এসেছে। দেবী ‘পার্বতী’ নামেও তিনি পরিচিতা।

বীরভূম-ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন আদিবাসীদের জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ আবার মাকে ‘উর্মিলা’, ‘শেফালিকা’ নামেও ডেকে থাকেন। চারচালা মন্দিরের সামনে প্রাচীন স্থাপত্যের কিছু কিছু নিদর্শন এখনও দেখা যায়। মন্দিরের গর্ভগৃহে সিঁদুর আর তেলে ঢাকা মা নলাটেশ্বরী বিরাজমান। পাথরের ওপর বসানো ত্রিনয়নী মায়ের মুখ। দু দিকের দাঁতের মধ্যে রয়েছে সোনার তৈরি জিভ। ওপরে রয়েছে রুপোর ছাতা। সিঁদুরচর্চিত মুখমণ্ডলের নিচে রয়েছে মায়ের কন্ঠনালী। ভোরবেলায় মায়ের স্নান ও শৃঙ্গারের সময়ে এই কণ্ঠনালীর দর্শন পান দর্শনার্থীরা। এখন যেমন মায়ের মুখমণ্ডল দেখা যায় প্রথমে তা ছিল না।

নলহাটির মাঝে রয়েছে ছোট্ট অনুচ্চ এক টিলা। তারই এক প্রান্তে দেবী নলাটেশ্বরীর অধিষ্ঠান। বহু সাধকের সাধনার সাক্ষী জঙ্গল ঘেরা এই পাহাড়। এক সময়ে এখানে, সাধারণ মানুষের তেমন আনাগোনা ছিল না। কেবলমাত্র যাতায়াত ছিল বীরাচারী তান্ত্রিকদের। আসতেন কাপালিকরাও।

কথিত আছে, প্রায় ৫০০ বছর আগে স্মরনাথ শর্মা নামে এক সাধক, স্বপ্নে দেবী নলাটেশ্বরীর দেখা পেয়ে জানতে পারেন, এখানেই সতীর খণ্ডিত দেহাংশ, শিলারূপে অবস্থান করছে। তারপর সাধক স্মরনাথই এই জায়গা আবিষ্কার করে দেবীর নিত্যপুজার ব্যবস্থা ও মাহাত্ম্য প্রচার করেন। মূল মন্দিরে শীলারূপী মা নলাটেশ্বরী।

অনেকে বলেন, সাধক স্মরনাথ শর্মা, এর আবিষ্কার করলেও পরে নাটোরের রানি ভবানী এই মন্দির তৈরি করেন। অনেকে আবার বলেন, ২৫২ বঙ্গাব্দে ব্রহ্মচারী কামদেব স্বপ্নাদেশে কাশী থেকে এসে এই পীঠস্থানটি আবিষ্কার করেন। কৃষ্ণ বসাক নামে এক স্বর্ণকার মায়ের এই রূপ দিয়েছিলেন। গর্ভগৃহে ঢোকার মুখে ওপরে রয়েছে গণেশ মূর্তি, তাকে ঘিরে রয়েছে আটটি সাপ। মন্দিরের উত্তর দিকে অবস্থিত পঞ্চমুন্ডির আসন। অনেক সাধক এই পঞ্চমুন্ডির আসনে সিদ্ধিলাভ করেছেন। জনশ্রুতি, কোনও এক ভৈরবী, এই জায়গাটি আবিষ্কার করেন। এখানে গণেশও পাহাড়ে গায়ে শিলারূপে অধিষ্ঠিত।

দিনের আলো ফোটার আগেই মূল মন্দিরে দেবীর মহাস্নান সম্পন্ন হয়। তারপর মঙ্গলারতি করে দিনের শুরু। তখন থেকেই ভক্তদের জন্য খুলে যায় মন্দিরের দরজা।

কথিত আছে, ভৈরব মন্দির স্থাপনের সময়, মাটির নীচ থেকে উঠে এসেছিল শ্রীবিষ্ণুর পদচিহ্ন আঁকা শিলাখণ্ড! আজও দেবী ও ভৈরবের আগে প্রতিদিন এই শিলাখণ্ডের পুজো হয়। তাই এই পীঠস্থানে শাক্ত ভাবধারার পাশাপাশি এসে মিশেছে বৈষ্ণব ভাবধারারও।

প্রণাম করার পর, আমি তারাপীঠে আমাদের হোটেলে ফিরে আসি।

জয় মা নলাটেশ্বরী!

One thought on “কালিকা শক্তিপীঠ শ্রী নলাটেশ্বরী মন্দির | নলহাটি

I'd love to hear your thoughts on this post! Please leave a comment below and let's discuss.