আমাদের রিজনাল ম্যানেজার সাহেব সকালে ভুঁড়ির উপর লাল টাই টেনে সেট করছেন, আর আয়নার দিকে তাকিয়ে বলছে — “ওকে”। চিরুনি বার কর মাথার উপরে যে আঠ-দশটি চুল অবশিষ্ট আছে তাদের উপরে বার কয়েক বুলিয়ে সেট করে নিলেন। টেনেটুনে প্যান্টের উপর বেল্ট বাঁধলেন একটু কষ্ট করে। ভুঁড়িটা যেন কমছেনা। আর কি? সামনে দুই মাসের মধ্যে রিটায়ারমেন্ট। যাই হউক, একটু ফুসফুস করে পারফ্যুম স্প্রে করে নিলেন। আজকে তার শেষ সরকারি অনুষ্ঠান। আজ রাষ্ট্রীয় হিন্দি দিবস।
ড্রাইভারকে ডেকে বললেন — “চলো অফিস। এগারোটার সময় মন্ত্রিজীর ফ্লাইট এসে পৌঁছাবে। সাথে হিন্দি অধিকারীকে নিয়ে যেও। পথে ৩০০ টাকা দিয়ে একটা ফুলের স্তবক নিয়ে নিও। নীলিমাকে বলে কম্পিউটার থেকে সুন্দর নামের ব্যানার প্রিন্ট করে নিও। ব্যানার টা তুমি ধর আর স্তবকটা নীলিমাকে দিও।” আমাদের সাহেব খুব নিয়ম মেনে চলে।
অফিসে ঢুকে এক নজরে পুরো অফিসটা দেখে ঢুকে পড়লেন নিজের ঘরে। সিংহাসনে বিরাজমান হয়ে চা খেতে খেতে হুকুম করলেন নীলিমাকে ডেকে পাঠাবার জন্য।
“নিলিমাজী গুড মর্নিং! আহা, আপনি আজকে ভালো করেছেন — শাড়ি পরে এসেছেন। হিন্দি অধিকারী লাগছেন। অন্যদিন জিনস পরে আসেন হিন্দির থেকে ইংরেজি অফিসার বেশী মনে হয়। আচ্ছা, মন্ত্রীজীর ফ্লাইট ১১টার সময় আসবে। রামু (ড্রাইভার) নিয়ে যাবে। পথে ফুলের স্তবক নিয়ে নিও। ভালো করে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এসো। রিপোর্ট যেন ভালো দ্যায়। আমি নিজেই যেতাম, কিন্তু কাছারিতে একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় মিটিং আছে। যাই হউক, ভালো করে সব ম্যানেজ করে নিও। আর আজকের অনুষ্ঠানের সব ব্যাবস্থা ঠিক আছে তো?”
“স্যার, এই সাড়ে বারোটার নাগাদ আমাদের অফিসের একটা নিরীক্ষণ করিয়ে দেবো, তার পরে ম্যানেজারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। টেবিলে হিন্দি ফাইল সব রাখা আছে … যদি দেখতে চায় তো দেখিয়ে দেবো। দুপুরে ১টা থেকে ২টো অব্দি কনফারেন্স রুমে হিন্দি সভা আছে। আপনি মুখ্য অতিথির পরিচয় এবং সম্মান করবেন, তারপরে ওনার আশীর্বচন শোনা হবে, হিন্দি প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ হবে, তারপরে আপনি আপনার ভাষণ দেবেন। শেষে আমি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে দেবো। ইতিমধ্যে লাঞ্চের ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। সবাই আমরা লাঞ্চ করতে যাবো …”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। আচ্ছা আমাদের অফিসে ওয়িক পয়েন্ট কে কে?”
“ভেঙ্কটেশ জী তো একদম হিন্দি লিখতে পারেন না। একটু একটু পড়ে নেন আর বলে নেন। আর আছেন ভাটিয়া জী। হিন্দি ভালো জানেন, কিন্তু ফাইলে টিপ্পনী ইংরেজিতেই করবেন। কিছুতেই শোনেন না। বাকি স্টাফ ঠিক আছে, স্যার।”
“আচ্ছা, এক কাজ কর — এই দুইজনকে মন্ত্রীজীর হাত দিয়ে দুটো পুরস্কার দিয়ে দিও … যে কোন বাহানা মেরে দিয়ো যে হিন্দির জন্য খুব পরিশ্রম করে, ইত্যাদি। গিফটে কোন পেনের সেট দিয়ে দিও। হ্যাঁ, আমার তো এটা শেষ ভাষণ, তাই কিছু স্পীকিং পয়েন্ট লিখে দাও। বাকি আমি সামলে নেবো।
মন্ত্রীজী এলেন, অফিসের নিরীক্ষণ হোল, কনফারেন্স রুমে হিন্দি সভা, পুরস্কার বিতরণ আদি সব ভালো ভাবেই, প্ল্যান মাফিক হোল। হিন্দি তে কাজ করার জন্য অভিবাদন দেওয়া হোল, প্রশংসা কারা হোল, আরও বেশী ভাবে কাজ করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হোল। নীলিমাজী শেষে আমাদের সাহেবকে দুই শব্দ বলার জন্য অনুরোধ করলেন। সাহেব পেটের বেল্ট টানতে টানতে উঠে হিন্দিতে ভাষণ দিলেন, যার সার হোল—
“মাননীয় মন্ত্রীজী আমাদের দিন ইংরেজী সংবাদপত্রের মাধ্যমে শুরু হয় এবং সন্ধ্যায় টিভি তে ইংরাজী সংবাদে শেষ হয়। এরকম নয় কি কেউ হিন্দী পড়তে পারে না, কিন্তু যদি হিন্দি একটু সরল হতো তবে সম্ভবত একটু দ্রুত পরিবর্তন সম্ভব হতো। আগে, ব্যাংকের সার্কুলারগুলি ইংরেজিতেই প্রকাশিত হতো, তারপর তাদের হিন্দি সংস্করণটি এক মাস পরে আসতো। এখন দুইভাষায় একসঙ্গে আসছে। কিন্তু হিন্দী সার্কুলারের শেষে, একটি লাইন লেখা হয় যে বিতর্কের ক্ষেত্রে ইংরেজির সার্কুলারটি বৈধ হবে। হিন্দি ভাষার প্রচলন বাড়ছে।
মন্ত্রীজী, আরেকটি ঘটনা হল যে জাপানে জাপানী ভাষার অফিসার নেই, রাশিয়ার রাশিয়ান ভাষার অফিসার নেই কিন্তু ভারতে হিন্দি ভাষার অফিসার আছে। এক-দুই জনের কথা বলছিনা, হাজারে হাজারে হিন্দি অধিকারীদের সন্তানরা ইংরেজী মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলিতে অধ্যয়নরত। ঠিক, হিন্দি ভাসার প্রচলন ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হবে।
আমার ইনিংস তো শেষ, আমি পরবর্তী হিন্দী দিবস পালন করতে পারব না। সবার শুভ ও মঙ্গল কামনা করি। ধন্যবাদ।”
সভা শেষ হোল। লাঞ্চ হবার পরে আর কি করা হবে? মন্ত্রীজীর ফ্লাইট তো সন্ধ্যে বেলায়। সময় অনেক আছে। রিজনাল ম্যানেজার সাহেব মন্ত্রীজীকে অনুরোধ করলেন জিমখানা ক্লাবে গিয়ে একটু বিশ্রাম করতে। উনি নিশ্চয়ই এতো কাজের পরে একটু কাহিল হয়ে গেছেন। প্রস্তাবটি মন্ত্রী মহোদয়ের পছন্দ হোল। উনি স্বীকার করে নিলেন। ওখানে বসে আরামে কিছু গল্প হোল বিলিতি মদের সাথে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ফ্লাইটের সময় হয়ে গেলো।
এয়ারপোর্টে মন্ত্রীজীকে বিদায় দিয়ে এই বছরের হিন্দি দিবস পালন সম্পূর্ণ হোল।
