সাধুভাষা

ফেইসবুকে নিম্নলিখিত রচনাটা পড়ে মনে হোল আপনাদের সাথে শেয়ার করি।

এখানে ‘প্রস্রাব করিবেন না।’ কেন বাবা, ‘এখানে পেচ্ছাপ করবেন না’ লিখতে কী দোষ? তাতে কি প্রস্রাব আরও বেগবান হবে?

সাধু বাংলা বাঙালির মজ্জায়। একটু সিরিয়াস ব্যাপার হলেই সাধুর দাড়ি ধরে টানাটানি। তাতে অবিশ্যি বঙ্কিমি স্বাদের কণামাত্র নেই, আছে বিশুদ্ধ ইতরামি। ‘রাস্তা বন্ধ। কাজ চলিতেছে।’ যেন কাজ চলছে লিখলে কাজ আর হবেই না। কিংবা ‘আগামীকল্য আমাদের সংঘের বার্ষিক সভা ভানুবাবুর বাটীতে বিকাল পাঁচ ঘটিকায় অনুষ্ঠিত হইবে।’ আমি ছেলেবেলায় ভাবতাম, বাটিতে কী করে সভা হবে? ওইটুকু তো সাইজ। লোকে বসবে কোথায়? ভানুবাবুর বাটি কত বড়? আহাম্মক কি গাছে ফলে!

এই যে ব্যাটা পটা। মাইক নিয়ে চিল্লিয়ে যাচ্ছে, ‘যাহারা যাহারা মহাষ্টমীর অঞ্জলি দিতে ইচ্ছুক তাহারা তাহারা অবিলম্বে মণ্ডপে চলিয়া আসুন।’ সাধুর এই মহামারীর জন্য দায়ী বোধহয় স্কুলশিক্ষা। আমাদের সময় পই পই করে বলা হত, ‘ভাষা দিয়ে লেখ।’ ভাষা দিয়ে মানে কঠিন ভাষা দিয়ে। যার ভাষা যত কঠিন, তার নম্বর তত বেশি। বানানেও তাই। সব ‘ঈ-কার’। জ্যোতিভূষণ চাকী লিখেছেন, কোনও ছাত্র যদি ‘বাড়ি’ লেখে তা হলে স্কুলে নির্ঘাত সেই বাড়ি মেরামত হয়ে হবে ‘বাড়ী।’ এখনও তেমন হয় কি না, জানি না। 

সবচেয়ে কাহিল অবস্থা বিয়ের ও শ্রাদ্ধের কার্ডের। বাঙালির পোশাকআশাক, খাবারদাবার—কত কী বদলে গেল। কিন্তু বিয়ে ও শ্রাদ্ধের চিঠির ভাষা সেই এক। ‘মদীয় বাসভবন’ থেকে ‘সাধনোচিত ধামে গমন’–এর রাস্তা যে কণ্টকাকীর্ণ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এর সঙ্গে ‘আশীর্বাদ করতঃ’, এবং ‘প্রজাপতি ব্রহ্মার আশীর্বাদে স্নাত’ যদি হন, তা হলে তো পোয়া বারো। বিয়ের চিঠির ভাষা একটু বদলাতে যান, সমাজপতিরা টিকি নাড়বেন। যেন সাধুভাষায় না-লিখলে বিবাহবিচ্ছেদ অনিবার্য। ভাষার মৌলবাদ অতি সাংঘাতিক। কোথায় যেন পড়েছিলাম, ‘আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্রের পঞ্চম পুত্র শ্রীমান অঘোরকান্তির সহিত পূর্বতন কুষ্টিয়া জেলা নিবাসী (অধুনা গঙ্গাবক্ষে নিমজ্জিত)…।’ বোঝো। এই কার্ড লিখবেন বলেই বোধহয় ভদ্রলোক এতদিন বেঁচে ছিলেন। 

আমার বিয়ের কার্ড লেখার সময় আমি আমার এক কাকুর কাছে পরামর্শ চেয়েছিলাম। কাকু বলল, ‘ল্যাখ, আমি অমুক তারিখে বিয়া করমু। সইন্দ্যাবেলায় আমাগো বাড়িত আইয়া দুগা ডাইল-বাত খাইয়া যাইবেন।’ এই বিপ্লবটা করতে পারলে নিজেকে চে গেভারা ভাবতাম। কিন্তু পারিনি। অগত্যা ওই আশীর্বাদ করতঃ…।

বাড়ির দলিল কোনওদিন পড়েছেন? আমি একবার পড়ার চেষ্টা করেছিলাম। দু’লাইন পড়ার পর মনে হল, কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার…। আমি বরং গৃহত্যাগী হই।

I'd love to hear your thoughts on this post! Please leave a comment below and let's discuss.