ঈশ্বরচন্দ্র সাক্ষী!

আজ সকালে আমাদের স্কুলের একজন বরিষ্ঠ ছাত্রের একটা পোস্ট পড়লাম ফেসবুকে। আমাদের স্কুলের, পুরানো পাড়ার কিছু সুন্দর ইতিহাস রয়েছে এই লেখায়। শেয়ার না করে পারলাম না।

সুপ্রাচীন আরাবল্লী পর্বতমালা মোটামুটি গুজরাট থেকে শুরু হয়ে উত্তর-পূবে রাজস্থান, হরিয়ানা পেরিয়ে দিল্লীতে যমুনার তীরে এসে শেষ হয়ে গেছে। পাহাড়ের যে শাখাটিকে দিল্লীতে পাওয়া যায়, ইংরেজরা তারই নাম দিয়েছিল ‘রিজ্‌’। শুকনো পাহাড়, বেশি উঁচু নয় — বড় বড় পাথরের আউটক্রপ, কাঁটাঝোপ, সেঁয়াকুল, বাবুল-কীকড় আর পলাশের জঙ্গল। জঙ্গলে ময়ূর, তিতির, শেয়াল আর বড় খরগোশ একসময়ে আমি নিজেই দেখেছি — আজও  হয়তো তারা আছে। আর ছিল দলে দলে বাঁদর। ঘিয়াসুদ্দীন তুঘ্‌লুকের মক্‌বরা থেকে শুরু করে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্থ-ক্যাম্পাস পর্য্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল বাঁদরদের একাধিক কলোনি।

নয়াদিল্লীর মধ্যভাগে, মন্দিরমার্গের উপর, এই রিজের গায়েই রাইসিনা ইস্কুল — রাইসিনা বঙ্গীয় বিদ্যালয়। ১৯২৫ সালে ইস্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অধুনালুপ্ত রাইসিনা গ্রামের কাছে, তাই এই নাম। ১৯১১ সালে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তরীত হবার সময়ে অনেক বাঙালী সরকারী কর্মচারী বদলি হয়ে এখানে এসেছিলেন। তাঁদের ছেলেদের বাঙালী পরিবেশে পড়াশুনা করাবার আকাঙ্খা থেকেই এই ইস্কুলের উৎপত্তি। শুনেছি, গোড়ায় একজন মাত্র শিক্ষক  ছিলেন ইস্কুলে — নাম তাঁর মাখনলাল মুখোপাধ্যায়। এখানে বলে রাখা ভালো, রাইসিনা ইস্কুল অতীতে কেবল ছেলেদের বিদ্যালয় হিসেবেই চালু হয়েছিল—মেয়েরা পড়তো কেবল ক্লাস সিক্স পর্য্যন্ত। ১৯৭৫ সালের পরে ইস্কুলটি কো-এডুকেশন্যাল হয়ে যায়।

মন্দিরমার্গে রাইসিনা ইস্কুলের মূল বাড়িটি  সুন্দর দেখতে। কলোনিয়াল স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি — আরাবল্লীর পাথরে গড়া উঁচু প্লিন্থের উপর গোল গোল মোটা থাম দেওয়া ছড়ানো একতলা বাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সামনে বেশ বড়সড় হলঘর, আর তার দু’পাশে অধ্যক্ষ মশায়ের কাম্‌রা এবং টীচার্সরূম। এই হলঘরে সরস্বতী পূজো থেকে শুরু করে ডিবেট প্রতিযোগিতা, সবই অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৭০র দশকে হলঘরের দেওয়ালে টাঙানো থাকতো শিল্পী অবনী সেন-র আঁকা একটি বিরাট ছবি — জানি না আজ আর সেটি আছে কিনা, বা থাকলেও কী অবস্থায় আছে! 

কলকাতার সরকারী আর্ট স্কুলের ছাত্র অবনীবাবু একসময়ে নয়াদিল্লীর ‘সারদা উকিল স্কুল অফ্‌ আর্ট’ ও রাইসিনা ইস্কুল — এই দুই জায়গাতেই ছবি-আঁকার ক্লাস নিয়েছেন। ছোট ছেলেপিলেদের ড্রইং-শিক্ষার জন্য তাঁর আঁকা একাধিক ছবির বই ছিল — ১৯৬০র দশকে আমি তাঁকে দেখেছি — গোলমার্কেটের বাড়িতে তাঁর নিজস্ব স্টুডিও ছিল।  বাবা তাঁকে ‘অবনীদা’ বলে সম্বোধন করতেন।

 এই প্রসঙ্গে দিল্লীর আরেকজন শিল্পীর নামটি কেবল এখানে উল্লেখ করে রাখতে চাই, তিনি শরদিন্দু সেনরায় — আমার বাবার ‘মন্টুদা’। এঁর কথা পরে বিস্তারীত লেখবার ইচ্ছা রইলো। অসাধারণ শিল্পী ছিলেন শরদিন্দুবাবু — লক্ষ্ণৌ আর্ট স্কুলের ছাত্র। 

রাইসিনা ইস্কুলের অবস্থান বোঝাতে উপরে মন্দিরমার্গের নাম লিখেছি বটে, কিন্তু কেবল মন্দিরমার্গ লিখলে সেই সময়ের পারিপার্শিক অবস্থা ও সমাজের কিছুই প্রায় বোঝানো যায় না! বরঞ্চ লেখা উচিৎ ছিল গোলমার্কেট—যাকে ঘিরে চারদিকে গজিয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের সরকারী হাট্‌মেন্ট্‌ (Hutment) আবাসের সমষ্টি—যেমন এডোয়ার্ড স্কোয়্যার, ডালহৌসি স্কোয়্যার ইত্যাদি। রাইসিনা ইস্কুলের অনেক ছাত্রের বাড়ি ছিল সেখানে, কারণ তাদের অভিভাবকরা ছিলেন সরকারী চাকুরে। নিকটেই নয়াদিল্লী কালীবাড়ি আর বিড়লাদের তৈরি করা লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির। লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরে ছিল ব্যায়াম করার আখড়া, তাও বাঙালীদের দখলে — ফলে গোলমার্কেটকে ঘিরে দোল-দুর্গোৎসব আর বিবাহ-অন্নপ্রাশন-শ্রাদ্ধানুষ্ঠান-গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি সব মিলিয়ে একটা মিশ্র-প্রাদেশিক প্রবাসী বাঙালী সংস্কৃতির আধিপত্য ছিল। তাই রাইসিনা ইস্কুলের স্মৃতিচারণে প্রবেশের আগে এই গোলমার্কেটের একটা সাধারণ বর্ণনা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। 

নামে বাজার হলেও এড্যুইন লাট্যিয়েন্স-র তৈরি গোলমার্কেট প্রকৃত অর্থেই যেন নয়াদিল্লীর একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল। দ্বাদশকোণ (Dodecagon) বাজারের মূল বাড়িটি ১৯২১ সালে তৈরি হয়েছিল শুনেছি। দু’পাশে গোল গোল বেঁটে থাম দেওয়া শপিং-আর্কেড। এই শপিং-আর্কেডের দোকানে  সেগুনকাঠের ফ্রেমে কাঁচের পাল্লা দেওয়া শোকেস। আজকাল আর সেরকম দেখাই যায় না। বাজারের মূল ইমারতটিতে ছিল মাছ-মাংসের বড় বড় দোকান।

১৯৪৭ সালে লাহোরের ভবেশচন্দ্র সান্যাল এই গোলমার্কেটেই স্থাপন করেছিলেন তাঁর ‘রিফিয়্যুজি স্টুডিও’, যা পরে ‘Studio 26’ নামে খ্যাতি লাভ করে। বহু শিল্পীর যাতায়াত ছিল সেখানে।  তবে ভবেশবাবুর স্টুডিও আমি স্বচক্ষে দেখিনি।

আমার ছাত্রাবস্থায় গোলমার্কেটের বাজারে বাঙালীদের একাধিক দোকান ছিল — যেমন, নগেনবাবুর ‘সরস্বতী বুক ডিপো’, সুরদের ‘কিতাবঘর’, মণ্ডলদের ‘মহামায়া বস্ত্রালয়’, গাঙ্গুলিদের ‘বেঙ্গল সুইট্‌ হোম’ — ছিলো ‘কমলা ভাণ্ডার’, ‘ভারত ভাণ্ডার’, বেয়ার্ড রোডের উপর ‘ব্রিটিশ মেডিকেল হল’ আর লেডি হার্ডিঞ্জ রোডের উপর আনুবাবু ও ভানুবাবুদের ‘গ্যালেন মেডিকেল হল’। 

এই দোকানগুলির মধ্যে ‘বেঙ্গল সুইট হোম’ বিশেষ পপুলার ছিল রাইসিনার মাস্টারমশাইদের মহলে — তাঁদের অনেকেই ইস্কুল ছুটি হবার পরে মিষ্টি খেয়ে তবে ঘরে ফেরার বাস ধরতেন। আমার নিজের কাছে অবশ্য খুবই আকর্ষণীয় ছিল ‘ভারত ভাণ্ডার’, সেখানে মাছ ধরার নানা রকম সুতো-বঁড়শী, হুইল ইত্যাদি পাওয়া যেতো। আজ আর এই সব দোকানের একটিও অবশিষ্ট নেই শুনেছি। আজকের দিল্লীতে এটা ভাবাই যায় না যে, গোলমার্কেটের মতো জায়গায় বসে বাঙালী বণিক একদিন মাছধরার সুতো-বঁড়শী পর্য্যন্ত বিক্রয় করেছেন!

এই ‘সরস্বতী বুক ডিপো’ সম্বন্ধে বাবা একটা দারুন গল্প শুনিয়েছিলেন। সেটাই বলি– 

ইংরেজদের আমলে নাকি বাইসাইকেলের ক্যারিয়ারে কোনো মানুষকে ক্যারি করা বেআইনী ছিল নয়াদিল্লী অঞ্চলে। তা সেবার কলকাতা থেকে বুড়োদা এসেছেন দিল্লীতে। তাঁর ভালো নাম  পরিমল উকিল — কালীঘাট-ক্লাবে ফুটবল খেলতেন, আর তাঁর মাথাভরা  যতরাজ্যের ফিচেল বুদ্ধি। তিনি বাবাকে সঙ্গে নিয়ে সাইকেল চালাতে গিয়ে ধরা পড়লেন পুলিশের হাতে। জরিমানা করতে গিয়ে পুলিশ জানলো টাকাপয়সা এদের পকেটে নেই। সে কাগজ-পেন্সিল বের করে কড়া গলায় বললে, ‘নাম বতাও, পতা বতাও’। তো বুড়োদা-ও সমান তেজে জবাব দিলেন, ‘ভদ্রঘর কা সন্তান হ্যায়, নাম লিখো – মেরা নাম বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ ঔর ইস্‌কা নাম বর্ণপরিচয় দ্বিতীয়ভাগ; ঠিকানা – সরস্বতী বুক ডিপো, গোলমার্কেট!’

পরে নাকি বাবার কাছে সরস্বতী বুক ডিপোর নগেনবাবু দুঃখ করেছিলেন— ‘দেশটা উচ্ছন্নে যাচ্চে ভায়া…এক পুলিশম্যানের সে কী হম্বিতম্বি, স্পষ্ট শুনলুম বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ আর দ্বিতীয়ভাগ চাই, তা আমি বের করে দেবার পরে আমায় এই মারে তো সেই মারে! আমিও বলেছি – তুই আমার কিস্যু করতে পারবি না… ঈশ্বরচন্দ্র সাক্ষী!’ 

2 thoughts on “ঈশ্বরচন্দ্র সাক্ষী!

I'd love to hear your thoughts on this post! Please leave a comment below and let's discuss.