আমার স্কুলের সহপাঠী, উজ্জ্বল দত্ত, আজকে একটা পুরানো স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো। সেদিন সকালে স্কুলে ঢুকবো, দেখি যে প্রিন্সিপাল স্যার শ্রী অমরনাথ ব্যানার্জী স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বেশ রাগ রাগ মুখ করে।
খুব স্বাভাবিক যে সকালে স্কুলে ঢোকার সময় আমরা অর্থাৎ ছাত্র ছাত্রীরা বেশ নানা রকম বকবক করতে করতে স্কুলে ঢুকি। কিন্তু আজ স্বয়ং প্রিন্সিপাল স্যারকে স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চুপচাপ স্কুলে ঢুকে গেলাম। আমার সাথে ছিল বন্ধু দেবাশীষ চ্যাটার্জি। স্যারকে পেরিয়ে একটু ভেতরে এসে দেবাশীষের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই দেবাশীষ চাপা গলায় বললো, “আজ ভাস্করের হবে এখন। ব্যাটা অনেকদিন ধরে স্যারকে ঘোরাচ্ছে। স্যার তিন চার বার ভাস্করকে বলেছেন যে তিনি ভাস্করের বাবার সাথে দেখা করতে চান। ও যেন ওর বাবাকে একবার স্কুলে নিয়ে আসে। কিন্তু ভাস্কর আজ না কাল করে স্যারকে ঘোরাচ্ছিল। কাল স্যার ভাস্করকে ওয়ারনিং দিয়েছিলেন যে আজ সকালে বাবাকে সাথে করে নিয়ে না এলে ভাস্করকে স্কুলেই ঢুকতে দেওয়া হবেনা। তাই স্যার সকাল থেকেই স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে আছেন যে ভাস্কর এলেই পাকড়াও করবেন।“
“ভাস্কর মানে ক্লাস ইলেভেন এ র ভাস্কর চ্যাটার্জি।“
“হ্যাঁ, ওই।“
“কিন্তু ভাস্কর তো বরাবরই ওই রকম। স্যার হঠাত এত রেগে উঠলেন কেন।“
“আরে জানিস না তুই। ভাস্কর তো কোনকালেই স্যার বা ম্যাডামদের তোয়াক্কা করেনা৷ দেখেছিস তো অত মারধোর খেয়েও ওর স্বভাব পাল্টায়নি। তো হয়েছে কি কিছুদিন আগে সান্ন্যাল স্যার এর ইংরেজির ক্লাস হচ্ছিল। স্যার ভাস্করকে কোন একটা প্যাসেজ পড়তে বলেছিলেন। ভুল ভাল উচ্চারণে ভাস্কর প্যাসেজটা পড়ে। তাতে স্যার রেগে গিয়ে বলেছিলেন, “তোদের বাঙ্গালী উচ্চারণ কিছুতেই যাবেনা। এত করে শিখিয়েও তোদের উচ্চারণ ঠিক হচ্ছে না। কিস্যু হবেনা তোদের মত বাঙ্গালীদের!” তাতে নাকি ভাস্কর বলেছিল, এসব কি আপনি যাতা কথা বলছেন স্যার। আপনিও বাঙ্গালী, আর আমরাও বাঙ্গালী। বাঙ্গালীদের উচ্চারণ সাহেবদের মতো হবে কি করে?” তাতে নাকি স্যার প্রচণ্ড রেগে খুব মার ধোর করেছিলেন ভাস্করকে। আর শুধু মার ধোর করেই ক্ষান্ত হননি, প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে নালিশ করেছেন। তাই প্রিন্সিপাল স্যার ভাস্করকে বলেছেন যে বাবাকে নিয়ে স্কুলে আসতে। “
“তুই এত কথা জানলি কি করে?”
“আরে এত অনেকেই জানে।”
আমরা দুজনেই স্কুলের গেটের কাছে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলাম। এবার ভেতরে যাবার জন্য পা বাড়াবো, হঠাত দেবাশীষ চাপা গলায় বলে, “দেখ, দেখ ভাস্কর এসে গেছে। কিন্তু ওর সাথে কে? ওর বাবা তো নয়।। চল তো একটু কাছে গিয়ে দেখি।”
প্রিন্সিপাল স্যারের বজ্রকণ্ঠ কানে আসে, “ভাস্কর, তোমার বাবা কোথায়? বাবা না এলে আজ কিন্তু স্কুলে ঢুকতে পারবে না।”
ভাস্কর খুব শান্ত গলায় বলে, “স্যার, বাবা একটা জরুরি কাজে আটকে গেছেন। তাই আমার বড়দা সাথে এসেছে।”
আমরা দেখি যে ভাস্করের সাথে একজন একুশ বাইশ বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিন্সিপাল স্যার সেই ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি ভাস্করের দাদা।”
“হ্যাঁ স্যার। বাবা একটু জরুরি কাজে আটকে গেছেন। তাই বাবা আমাকে বললেন আপনার সাথে দেখা করতে। স্যার বলুন, আমার ভাই কি করেছে।”
“দেখ, তোমার ভাই পড়াশোনা তো ঠিক মত করেই না উল্টে স্যার দের সাথে কথা কাটাকাটি করে। অসভ্যতামি করে। এই বছর ক্লাস ইলেভেন। পরের বার টুয়েলভে উঠবে। তার পর বোর্ডের পরীক্ষা। এইভাবে চললে হবে।”
সেই ভদ্রলোক বা ছেলেটি এই সব শুনে হঠাতই খুব রেগে গেলেন ও দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ভাস্করের দিকে তেড়ে গেলেন। ” পাজি অসভ্য ছেলে। স্কুলে এসে বাবা মা র নাম ডোবাচ্ছ। তোকে ভাই বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে। দেখ আজ তোকে কি করি।”
এই সব বলতে বলতেই উনি ভাস্করের পিঠে দুই চড় লাগিয়ে দিলেন।”
স্কুলের প্রেয়ারের সময় হয়ে গেছে প্রায়। স্কুলের সামনে ব্যাস্ত রাস্তা – মন্দির মার্গ। এই সব কারণে রাস্তায় ভিড় জমছে। তাই প্রিন্সিপাল স্যার সেই ভদ্রলোককে থামিয়ে দেন। তারপর বলেন, ” জানি তোমার খারাপ লাগছে। কিন্তু এখানে ওকে এখন মার ধোর করোনা। বাড়িতে গিয়ে বাবাকে সব খুলে বলো। আমরা ভাস্করের ভালোই চাই। তাই তোমার বাবাকে ডেকেছিলাম। ভাস্কর, প্রেয়ারে যাও। “
আমরা গুটি গুটি পায়ে প্রেয়ার এসেম্বলির দিকে পা বাড়ালাম। সেই ভদ্রলোক প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে আরো দু’একটা কথা বলে চলে গেলেন।
এই ঘটনার পর ছ’ সাত দিন কেটে গেছে। একদিন রিসেস টাইমে আমরা খেলছি। হঠাত দেখি বেয়ারা জবর সিং খুব হন্তদন্ত হয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে, ” ক্লাস ইলেভেন এ কা ভাস্কর চ্যাটার্জি হ্যায় ইঁহাপে। উনকো প্রিন্সিপাল স্যার নে বুলায়া হ্যায় তুরন্ত। “
ভাস্কর ওখানে নেই জেনে জবর সিং ভাস্করের খোঁজে অন্যদিকে চলে যায়।
কয়েক মিনিট পরে হঠাত আমাদের মনে হয় কি ব্যাপার হল হঠাত। কৌতুহলবশত প্রিন্সিপাল রুমের কাছে গিয়ে উঁকিঝুকি মেরে দেখি যে একজন ভদ্রলোক ভাস্করের কান ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছেন আর চেঁচাচ্ছেন,
“হতভাগা ছেলে, এত গুণ তোর। এই জন্যে তোকে স্কুলে পাঠাচ্ছি।” আর প্রিন্সিপাল স্যার বেত দিয়ে ভাস্করের হাতে পায়ে মেরে চলেছেন। এর সাথে ভাস্করও পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে।
পরে আমরা জানতে পেরেছিলাম যে ঘটনাটা কি হয়েছিল। হঠাতই সেদিন কথা নেই, বার্তা নেই ভাস্করের বাবা স্কুলে চলে এসেছিলেন। আর স্কুলে এসেই সোজা প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে দেখা করতে গেলেন। সেই সময় গার্জেনদের প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করার জন্য আগে থেকে এপোয়েনমেন্ট নিতে হতনা।
ভাস্করের বাবার পরিচয় পেয়ে প্রিন্সিপাল স্যার বললেন যে, “আপনার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছা ছিল। ভাস্করের ব্যাপারে কিছু আলোচনা করার ছিল। তা আপনার বড় ছেলে তো সেদিন এসেছিল স্কুলে। তাকে আমি সব বুঝিয়ে বলেছি। সে আপনাকে সব বুঝিয়ে বলেছে তো।”
তাতে নাকি ভাস্করের বাবা আকাশ থেকে পড়ে বলেছিলেন, “কি বলছেন স্যার। আমার আবার কোন বড় ছেলে এসে আপনার সাথে দেখা করেছিল। ভাস্করই তো আমার বড়ছেলে।”
“এঁ কি বলছেন আপনি। সত্যিই তাই! এই জবর সিং, ক্লাস ইলেভেন এ কা ভাস্কর চ্যাটার্জি কো ঢুঁঢকে লে আও… তুরন্ত।“
পরে জানতে পারা গেছিল যে প্রিন্সিপাল স্যারের ক্রমাগত চাপ সহ্য করতে না পেরে ভাস্কর কোন এক পরিচিত বাঙ্গালী ছেলেকে দশ টাকা দিয়ে দাদার ভূমিকায় নামিয়েছিল। আর সে ভদ্রলোকও এত সুন্দর অভিনয় করেছিলেন যে আমাদের বিদ্বান প্রিন্সিপাল স্যারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেননি।
এটা ছিল আমাদের স্কুল জীবনের এক অতি বিখ্যাত ঘটনা। পরবর্তী জীবনে যখনই ভাস্করের সাথে দেখা হয়েছে তখনই আমরা এই ঘটনাটা নিয়ে অনেক আলোচনা ও হাসাহাসি করেছি। ভাস্কর হাসতে হাসতে বলত, “আমার কপাল দেখ। যে জন্য এত কিছু করলাম তার শেষ রক্ষা হলনা। বাবা ঠিক গিয়ে হাজির হল স্কুলে আর সব ফাঁস হয়ে গেল।”
বন্ধুবর ভাস্কর চলে গেছে অমৃতলোকে ডিসেম্বর মাসে ২০২০তে। কিন্তু আজও ওর কথা মনে হলেই ওর সেই কণ্ঠস্বর মনে পড়ে – “স্যার, বড়দা এসেছে।”

I neither remember this incident nor Bhaskar…
LikeLiked by 1 person
1981 সালে পাস আউট। পাহাড়গঞ্জ বা বিড়লা মন্দিরের কোথাও থাকতো। শেষ ঠিকানা ছিল রোহিণী। বাবুয়াদের পূজা কমিটির সভাপতি ছিলো। সর্বশেষ ছিলো শিবু সোরেনের সঙ্গে- PA.
LikeLiked by 1 person
ঝাড়খন্ড এর সঙ্গে জড়িত ছিল তাই তোর মনে আছে 😂😂
LikeLiked by 1 person
😄😄
LikeLike