সন্ধিপূজা: ক্ষণিকের মধ্যে অনন্তের দীপ্তি

দুর্গাপূজা বাঙালির কাছে কেবল উৎসব নয়—এটি এক মহাজাগতিক নাট্যমঞ্চ, যেখানে ভক্তি, শক্তি আর মানবজীবনের অন্তর্লীন প্রবৃত্তি মিলেমিশে যায়। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণ, মাত্র আটচল্লিশ মিনিটের এক ক্ষুদ্র সময়, কিন্তু তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে মহাশক্তির সর্বোচ্চ প্রকাশ। এই সময়েই দেবী দুর্গা চামুণ্ডারূপে আবির্ভূতা হন—ভয়ঙ্করী অথচ স্নেহময়ী, ধ্বংসকারিণী অথচ মুক্তিদাত্রী।

পুরাণকথার অন্তরালে

চণ্ড ও মুণ্ড—এই দুই অসুরের নাম আমরা প্রায়ই শুনি। মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত দেবীর উপর যখন তারা হঠাৎ আক্রমণ করে, তখন দেবীর ক্রোধ সীমাহীন হয়ে ওঠে। ভ্রুকুটি থেকে জন্ম নেন চামুণ্ডা: শ্যামবর্ণা, ত্রিনয়নী, গলায় মুণ্ডমালা, পরনে বাঘছাল, হাতে খট্বাঙ্গ ও চন্দ্রহাস। তাঁর রূপ ভয়ঙ্কর, কিন্তু সেই ভয় আসলে মানুষের অন্তর্গত অন্ধকারকে ধ্বংস করার প্রতীক।

চণ্ড-মুণ্ডকে বধ করা মানে কেবল পুরাণের যুদ্ধ নয়—এটি মানুষের ভেতরের ভোগ ও ত্যাগ, প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির সংঘাতকে জয় করার রূপক।

সন্ধিপূজার আচার ও প্রতীক

সন্ধিপূজার সময় দেবীকে নিবেদন করা হয় একশো আটটি পদ্মফুল ও একশো আটটি প্রদীপ। পদ্ম ভক্তির প্রতীক, দীপ জ্ঞানের প্রতীক। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড়ো নৈবেদ্যের থালা, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপচার, সবচেয়ে গভীর আরাধনা—সবই নিবেদিত হয় দেবীর চরণে।

ঐতিহ্যগতভাবে, সন্ধিপূজার শুরু ও শেষ কামানের তোপ দিয়ে ঘোষণা করা হতো। বলি, পুষ্পাঞ্জলি, আরতি ও স্তবপাঠের মাধ্যমে পূজা সমাপ্ত হয়। শাস্ত্রে উল্লেখ আছে—সন্ধিপূজা দর্শন করলে সাত জন্মের তীর্থযাত্রার ফললাভ হয়।

ॐ দংষ্ট্রাকরালবদনে শিরোমালাবিভূষণে।
চামুণ্ডে মুণ্ডমথনে নারায়ণি নমোঽস্তু তে॥

দার্শনিক তাৎপর্য

চামুণ্ডা কেবল ভয়ঙ্করী দেবী নন। তিনি মানুষের ভেতরের মৃত্যুভয়, যমদুঃখ ও অন্ধকার শক্তিকে নাশ করেন। তাঁর পূজা মানে নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা, শক্তিকে সঠিক পথে ব্যবহার করা, আর আত্মাকে মুক্তির পথে এগিয়ে দেওয়া।

এই ক্ষণিক সময় আমাদের শেখায়—মানুষের অন্তর্জগতে শক্তি ও দুর্বলতা দু’টিই আছে। চামুণ্ডার আরাধনা মানে নিজের দুর্বলতাকে শাসন করা এবং অন্তর্নিহিত শক্তিকে প্রকাশ করা।

আজকের প্রেক্ষাপটে সন্ধিপূজা

আজকের দিনে, যখন আমরা প্রতিদিন নানা প্রলোভন, বিভ্রান্তি আর অস্থিরতার মধ্যে বেঁচে আছি, তখন সন্ধিপূজা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—অন্ধকারকে জয় করার শক্তি আমাদের ভেতরেই আছে। চণ্ড-মুণ্ড হয়তো আজ আর পুরাণের অসুর নয়, কিন্তু তারা রূপান্তরিত হয়েছে আমাদের লোভ, ভয়, হিংসা, আর অস্থিরতায়।

সন্ধিপূজা তাই কেবল পূজামণ্ডপের আচার নয়, বরং এক অন্তর্দর্শনের মুহূর্ত। এটি আমাদের শেখায়—ক্ষণিকের ভেতরেও অনন্তকে ধরা যায়, আর ভয়ঙ্করীর ভেতরেও লুকিয়ে থাকে মুক্তির আলো।

সন্ধিপূজা বাঙালির কাছে এক রহস্যময় ক্ষণ, যেখানে সময় থেমে যায়, আর দেবী চামুণ্ডার রূপে প্রকাশ পায় মহাশক্তির দীপ্তি। এটি কেবল ভক্তির আচার নয়, বরং মানবজীবনের এক গভীর শিক্ষা—অন্তর্গত অন্ধকারকে জয় করে সত্যশক্তিকে জাগ্রত করা।

ব্যক্তিগত অনুভব

Indrosphere-এর ভ্রমণ, সংস্কৃতি আর স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে বলতে পারি, জীবনের নানা সন্ধিক্ষণেও আমি সন্ধি পূজার প্রতীক খুঁজে পেয়েছি। প্রতিটি সংকট যেন সেই ৪৮ মিনিটের মতো—অস্থির, ভয়ংকর, কিন্তু শেষপর্যন্ত অশুভকে জয় করে শুভের উন্মেষ ঘটে। ঢাকের শব্দ, প্রদীপের আলো, দেবীর চামুণ্ডা রূপ—সব মিলিয়ে সন্ধি পূজা আজও আমার কাছে ভক্তি, ভয় আর আশ্রয়ের এক মেলবন্ধন।

2 thoughts on “সন্ধিপূজা: ক্ষণিকের মধ্যে অনন্তের দীপ্তি

Leave a reply to Indrajit Roy Choudhury Cancel reply