চাইনিজ ওয়াল গোষ্ঠ পাল

দর্শনা স্টেশনে বাক্সের মধ্যে গোষ্ঠ পালের ছবি দেখে পাক সীমান্ত রক্ষী বললেন আগে বলবেন তো আপনি গোষ্ঠ পালের মা…! ঘটনা ভারত ভুখণ্ড খণ্ডিত হবার কিছু পরের…তারপর!

দর্শনা স্টেশনে এসেছেন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এক বৃদ্ধা, সম্বল বলতে হাতের একটা লাঠি, আর ছোট টিনের তোরঙ্গ৷ পাকিস্থানের প্রহরীরা জবরদস্ত খানা-তল্লাশি করছেন, বর্ষীয়সী রমণীকে বেশি ঘাটতে হল না,প্রহরীর শ্যেনদৃষ্টি মেলে ধরল তাঁর বাক্সবন্দী সম্পদের দিকে, সযত্নে সেখানে সাজানো এক ফটো, এবার অবাক হওয়ার পালা৷

খোলো দেখি বাক্স,হেঁকেই হুকুম প্রহরীর, তোরঙ্গের ডালা তুলে ধরলেন বৃদ্ধা, প্রহরীরও শ্যেনদৃষ্টি ওই বাক্সের দিকে৷

প্রহরী জিজ্ঞেস করলেন এই ফটো কার?
উনি আপনার কে?
বৃদ্ধার কণ্ঠেও বিস্ময়৷ কেন?ও তো আমার পোলা!

নিমেষে দুঁদে পাক সীমান্ত রক্ষীর আচরণে কেমন যেন ভদ্রদুরস্ত আবহ, আবেগে তিনিও ভেসে যাচ্ছেন৷ বললেন আগে বলতে হয় এসব, শুধু কত কষ্ট দিলাম,তা আগে বলবেন আপনি গোষ্ঠ পালের মা জননী, সঙ্গে আরও বললেন তাকে যেন তিনি মাপ করে দেন৷

পাকিস্থানের সীমান্ত রক্ষী আরও বলেছিলেন আপনি একা গোষ্ঠ পালের মা নন, তিনি তাঁদেরও জননী৷ সব কথা বলে ওই রক্ষী জননীর পায়ের ধুলো ভক্তিভরে নিজের মাথায় ঠেকালেন, তারপর সব কাজ ছেড়ে মাকে নিয়ে পড়ে থাকলেন যতক্ষণ না পশ্চিমমুখী ট্রেন ছাড়ে৷ ট্রেনের কামরায় মায়ের জায়গা করে দিয়ে বাঙ্কের ওপর তোরঙ্গ তুললেন নিজের হাতে৷

বৃদ্ধা কিন্তু বুঝতে পারেন না তাঁর ছেলের কেন এত কদর, তাঁর পুত্র না বড় রাজনৈতিক নেতা, না বড় সরকারি অফিসার, না বিত্তবান ব্যবসায়ী৷ তাহলে কেন পাকিস্থানের প্রহরী এত সম্মান করল তাকে! এসব ভাবতে-ভাবতে চলে এলেন এপার বাংলায়,স্টেশনে ছেলে গোষ্ঠ পাল অপেক্ষা করছেন৷

মাকে দেখে পুত্র প্রশ্ন করলেন রাস্তায় অসুবিধা হয়নি তো, এরপর মায়ের মুখে শুনলেন সব গল্প৷ এবার পুত্র অনুযোগের সুরে বললেন দেখলে মা তখন কেবল ধমকাতে, লেখাপড়া নেই, কাজকর্ম নেই, শুধু খেলা৷ আজ বুঝতে পারছো খেলার কত দাম৷

পুত্রের কথায় মা জননী না হেসে পারেন না, তাঁর ছেলে বড় খেলোয়াড়, কেমন খেলেন তিনি কোনওদিন দেখেননি, শুধু বুঝতেন সে মস্ত বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে, তাঁকে নিয়ে একসময় খুব হইচই উঠেছিল৷

গোষ্ঠ পালের মায়ের কাছে ছিল সবটা শুধুমাত্র খেলা, সে খেলার মূল্য তিনি জানতেন না, তবে বুঝতেন যেদিন ছেলে মাঠের ব্যাথা ঘরে এনে তাঁকে বলতেন গরম জল করো, চুন-হলুদ লাগিয়ে দাও৷ তিনি অবশ্য সব কাজকর্ম ফেলে বলে উঠতেন কীরে ব্যাথা কমল? কোনওদিন জননী রাগের সুরে বলেছেন হাত-পা ভাঙবি শেষে! তবু ছেলে সেসব কথা কানেই তোলেননি, লুকিয়ে খেলার মাঠে এসেছেন৷

ছেলেকে আটকাতে না পেরে মা হতেন রেগে খুন, তবু আমরা ভাবি ভাগ্যিস গোষ্ঠ পাল জননী নিজে হেরেও জিতিয়ে দিয়েছেন আমাদের, আমরা পেয়েছি ইতিহাসের অবিস্মরণীয় নায়ক, ফুটবল কিংবদন্তি গোষ্ঠ পালকে যিনি নিজেই পরিচিত চীনের প্রাচীর নামে৷

গোষ্ঠ পালের নামে প্রথম জয়ধ্বনি উঠেছিল গত শতাব্দীর গোড়ার পর্বে, তারপর অনেক কাণ্ড ঘটেছে, গোরারা এদেশ ছেড়েছে, বিংশ শতক ফুরিয়েছে, কিন্তু গোষ্ঠ পালের নামডাক এতটুকু থিতিয়ে যায়নি,আত্মবিস্মৃত জাতি হিসেবে বাঙালির নাম থাকলেও বাঙালি কিন্তু কোনদিনও দিন ভুলতে চায়নি চাইনিজ ওয়াল গোষ্ঠ পালের কথা৷

2 thoughts on “চাইনিজ ওয়াল গোষ্ঠ পাল

Leave a reply to Indrajit Roy Choudhury Cancel reply