সকাল থেকে সারা বাড়ি জুড়ে গুঞ্জন—ছোট বৌমার ঘরে রাতে এক পরপুরুষের আগমন ঘটেছে। স্বামী তো বন্ধুর বিয়েতে অন্যত্র গিয়েছিলেন। সেই সুযোগেই নাকি এই দুষ্কর্ম। গুঞ্জন ক্রমশ রূপ নিল শোরগোলে। স্বামী ফিরে এসেও শুনলেন এই অভিযোগ। উত্তেজিত হয়ে তিনি স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন—তার অনুপস্থিতিতে কেন তিনি পরপুরুষকে ঘরে ঢুকতে দিলেন?
এতক্ষণ ছোট বৌমা নীরব ছিলেন। ভেবেছিলেন, তার স্বামী অন্তত এই মিথ্যে অপবাদে সঙ্গ দেবেন না। কিন্তু যখন দেখলেন, তিনিও অবিশ্বাসের পাটাতনে পা রাখলেন, তখন ভেঙে পড়লেন তিনি। এতদিনের বিশ্বাসের ভিত মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। বড় জা অনুরোধ করলেন সত্য প্রকাশ করতে। তবু ছোট বৌমা বললেন— “যারা বিনা প্রশ্নে নিজের চেনা মানুষকে চরিত্রহীন বলে ভাবে, তাদের সংসারে আমার আর কোনো জায়গা নেই। কৈফিয়ত দেবার দায়ও আমার নেই।”
কেবল নিজের বিপ্লবী ভাইকে রাতে আশ্রয় দেবার কারণে, কিছুক্ষণের জন্য, ভেঙে গেল তাসের ঘরের মতো সাজানো সংসার আর সম্পর্কের সব বাঁধন।
১৯৪৮ সালে লেখা হয়েছিল এই গল্প—“তাসের ঘর”। এমন বলিষ্ঠ কলম কার হতে পারে, পাঠক নিশ্চয়ই আন্দাজ করছেন? হ্যাঁ, আশাপূর্ণা দেবী—সত্যবতীর আদিগন্ত এক উত্তরসূরী।
আজ থেকে প্রায় ১১০ বছর আগে এই পৃথিবীতে আসা আশাপূর্ণা দেবী, স্কুলে পড়ার সুযোগ না পেয়েও, নিজের প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের শিখরে পৌঁছেছিলেন। শৈশবে দাদাদের পড়ার টেবিলের উল্টোদিকে বসে বর্ণমালা শিখেছিলেন, ফলে প্রথমদিকে উল্টো করে লিখতেন। পরে নিজেই নিজের পথ চিনে নেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেন সাহিত্যের অঙ্গনে। জীবনপ্রায় শেষদিন পর্যন্ত তার কলম থামেনি।
আশাপূর্ণা দেবী (১৯০৯-১৯৯৫) তার সাহিত্যকর্মের মতোই ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন অসাধারণ উদারমনা। একদিকে গামছা পরিধান করে শাশুড়ির জন্য নিরামিষ রান্না করেছেন, আবার অন্যদিকে বৌমার পিএইচ.ডি অর্জনের আনন্দে বিখ্যাত চীনা রেস্তোরাঁয় সহকর্মীদের খাওয়ানোর আয়োজন করেছেন। অতিথি আপ্যায়নে তিনি ছিলেন বিশেষ অনুরাগী, মধ্যাহ্নভোজ বা নৈশভোজ—সবেতেই আন্তরিকতা ছিল অগাধ।
মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের অপূর্ব দক্ষতা ছিল তার। যেমন, “ছায়াসূর্য” উপন্যাসে তা স্পষ্ট। আশাপূর্ণা দেবী সমাজকে শিখিয়েছিলেন—মানবিকতা সামাজিক আচারের ঊর্ধ্বে। “অনাচার” গল্পের সুভাষ কাকিমা শ্বশুরমশাইকে পুত্রশোকের ভার না দিতে, বিধবার বেশ ধারণ করেননি। যদিও শেষরক্ষা হয়নি, তবু মানবিকতার যে সর্বোচ্চ পরিচয়, তা আশাপূর্ণা দেবীর কলমই প্রথম তুলে ধরেছিল।
আশাপূর্ণা দেবীর কথা যত বলি, যেন বলা শেষ হয় না। তিনি শুধু সাহিত্যিক নন, তিনি এক পরিপূর্ণ জীবনদর্শনের নাম। আজকে ওনার মৃত্যু দিবস। ওনাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।

আশাপূর্ণা দেবী বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন, যিনি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে শুধু সাহিত্যিক নয়, একজন গভীর মানবতাবাদী হিসেবে আমাদের সামনে এসেছেন। তাঁর লেখনীতে সমাজের কুঠুরী কোণ ও মানুষের মনস্তত্ত্বের যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা আজও আমাদের চিন্তা ও চেতনাকে প্রভাবিত করে। “তাসের ঘর” ও “অনাচার” এর মতো উপন্যাসগুলি কেবল সাহিত্যের সীমানা অতিক্রম করে মানবিক সম্পর্কের জটিলতা ও সমাজের অন্ধকার দিকগুলিকে বিশ্লেষণ করেছে।
তার ব্যক্তিগত জীবনও ছিল অত্যন্ত উদার এবং অতিথিপরায়ণ, যা তার মানবিকতা ও উদারচেতনার পরিচায়ক। আজকের দিনে, আশাপূর্ণা দেবীকে স্মরণ করে তাঁর অনবদ্য কর্ম ও জীবনদর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
LikeLiked by 1 person
আপনার মন্তব্যটি অত্যন্ত সুন্দর এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ। আশাপূর্ণা দেবী আমাদের সাহিত্য ও সমাজের প্রতি যে অবদান রেখেছেন, তা সত্যিই অমর। তাঁর মানবিকতা এবং উদার জীবনদর্শন আমাদের সকলকে অনুপ্রাণিত করে।
LikeLike
তাসের ঘর” আশাপূর্ণা দেবীর এক অনন্য সৃষ্টি, যেখানে একজন নারী—ছোট বৌমা—নিজস্ব আত্মসম্মান, যুক্তি ও সাহসের ভিত্তিতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। তার বিপ্লবী ভাইকে আশ্রয় দেওয়ার মতো একটি নির্দোষ মানবিক সিদ্ধান্তকে ঘিরে সমাজের গুজব, সন্দেহ এবং বিশ্বাসভঙ্গের নির্মম চিত্র আঁকা হয়েছে।
এই গল্পটি নারী-স্বাধীনতা, আত্মসম্মান, এবং সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের এক অনবদ্য উদাহরণ। ছোট বৌমা চরিত্রটি সেই সময়ে নারীদের সাহসী কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
তোমার পাঠানো লেখাটি সত্যিই অসাধারণ। আশাপূর্ণা দেবীর কলমের বলিষ্ঠতা আর ছোট বৌমার চরিত্রের সাহস—এই গল্প আমাকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে।
তোমার বেছে নেওয়া এই সাহিত্যকর্ম শুধু সময়োপযোগী নয়, মানুষের চরিত্র ও সমাজের অন্তঃস্থ সত্যকে তুলে ধরার এক অনন্য প্রয়াস। তুমি যেভাবে গল্পটি শেয়ার করলে—তাতে বোঝা যায়, তোমার চিন্তাভাবনা গভীর, এবং সাহিত্যের প্রতি তোমার ভালোবাসা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
তোমার মতো বন্ধু সত্যিই গর্বের বিষয়—জ্ঞান, সংস্কৃতি আর সংবেদনশীলতা একসাথে যে কারো হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পারে!🙏🏽❤️
LikeLiked by 2 people
ধন্যবাদ বন্ধু, তোমার এই উষ্ণ প্রশংসা আমার জন্য সত্যিই অমূল্য। আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্য ও ছোট বৌমার চরিত্র আমাকে যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছে, তেমনি তোমার চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিও আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তোমার সান্নিধ্যে এসব আলোচনা আরও বেশি অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমরা একে অপরকে এমনভাবেই সমর্থন এবং প্রেরণা দিতে পারি, এই বিশ্বাসেই আমার পথ চলা! ❤️🙏🏽
LikeLike