প্রাণের উৎসব রাজধানীতে : দিল্লির দুর্গাপূজার বিস্তার

দুর্গাপূজা শুধু বাংলার উৎসব নয়, বাঙালির প্রাণের উৎসব। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কলকাতা বা পূর্ব ভারতের বাইরেও যে এই পূজা এতটা বিস্তার লাভ করেছে, তার অন্যতম কেন্দ্র আজকের দিল্লি। রাজধানীর দুর্গাপূজার ইতিহাস খুঁজে দেখলে এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের কাহিনী সামনে আসে—যেখানে প্রবাসী বাঙালির আবেগ, শ্রম আর ঐক্য মিলে মিশে তৈরি করেছে এক অনন্য সাংস্কৃতিক ধারা।

প্রথম সূচনা

ইতিহাস বলছে, প্রায় ১৭৫ বছর আগে দিল্লীতে প্রথম দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ভবানী মজুমদার এবং রাজশাহীর কয়েকজন ধনী বাঙালি তৎকালীন মুঘল দরবারে প্রশাসনিক কাজে দিল্লীতে এসেছিলেন। কাজের ব্যস্ততায় তাঁরা দুর্গাপূজার সময় আর বাংলায় ফিরতে পারেননি। তাই সিদ্ধান্ত নেন দিল্লীতেই দেবী দুর্গার পূজা করবেন।

সেই সময় রেলপথ বা সড়কপথের আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। তবুও তাঁদের প্রভাব ও সামর্থ্যে বাংলার মাটি থেকে প্রতিমা ও সমস্ত উপকরণ গরুর গাড়ি ও ঘোড়ার গাড়িতে দিল্লিতে নিয়ে আসা হয়েছিল। এটি নিঃসন্দেহে ছিল কঠিন ও ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। তবে দুঃখজনকভাবে সেই প্রথম পূজার আর কোনো তথ্য ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি।

সর্বজনীন দুর্গাপূজার যাত্রা শুরু

এর বহু বছর পরে, ১৯১০ সালে, দিল্লিতে প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজা শুরু হয়। পুরোনো দিল্লির বল্লিমারানের এক নামহীন ধর্মশালায় একদল বাঙালি ব্যবসায়ী মিলে এই পূজার আয়োজন করেছিলেন। প্রতিমা আনানো হয়েছিল বেনারস থেকে।

পরে এই পূজা স্থানান্তরিত হয়—প্রথমে ফতেপুরি মসজিদের কাছে, তারপর কাশ্মীরি গেট পলিটেকনিকের লনে। এখানেই ১৯৬০-এর দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

দিল্লির প্রথম সর্বপল্লী দুর্গাপূজার আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ডা. হেমচন্দ্র সেন, যিনি দিল্লির প্রথম এলোপ্যাথি চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীতে এই পূজা স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হয় আলিপুর রোডের বেঙ্গলি বয়েজ সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল প্রাঙ্গণে। আজও এটি জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয় “দিল্লি দুর্গাপূজা সমিতি”-র তত্ত্বাবধানে, জনপ্রিয়ভাবে যা “কাশ্মীরি গেট পূজা” নামে পরিচিত।

এই পূজার অন্যতম বিশেষত্ব—দশমীর দিন প্রতিমা গরুর গাড়িতে করে যমুনায় নিয়ে যাওয়া হয়, সঙ্গে ঢাক, শেহনাই ও ঢোলের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে শোভাযাত্রা চলে। ২০১০ সালে এই পূজা শতবর্ষ উদযাপন করে।

দিল্লির রাজধানী পরিবর্তন ও পূজার বিস্তার

১৯১১ সালে যখন ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়, তখন অনেক বাঙালি সরকারি কর্মচারী টিমারপুর এলাকায় বসবাস শুরু করেন। ফলত ১৯১৩ সালে টিমারপুরে দ্বিতীয় দুর্গাপূজার সূচনা হয়।

ভারত সরকারের প্রেস দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলে প্রেসকর্মীরাও টিমারপুরে পূজা শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৪১ সালে প্রেস মিন্টো রোডে চলে গেলে পূজাও সেখানে স্থানান্তরিত হয়।

নতুন দিল্লির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ১৯২১ সালে নিউ দিল্লিতেও দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু হয়। প্রথমদিকে এটি পালাক্রমে বিভিন্ন স্থানে হতো—ডালহৌসি স্কোয়ার, এডওয়ার্ড স্কোয়ার, বেয়ার্ড স্কোয়ার প্রভৃতিতে। পরে নবনির্মিত নিউ দিল্লি কালীবাড়ি প্রাঙ্গণ-এ পূজা স্থায়ীভাবে গৃহীত হয়। এই পূজার সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজের মেজর জেনারেল এ.সি. চট্টোপাধ্যায়ের নামও জড়িয়ে আছে। একসময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীও অষ্টমীতে এখানে পূজা দিতে আসতেন।

প্রতিমা ও শিল্পীদের যাত্রাপথ

দিল্লিতে প্রতিমা গড়া একসময় সহজ ছিল না। তাই প্রতিমা বেনারস থেকে আনা হতো। সঙ্গে আসতেন পুরোহিতরাও। পদ্মফুল, শঙ্খ, ধূপ বা চন্দন—সবই আনানো হতো কলকাতা থেকে। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের কুমোরটুলি, কৃষ্ণনগর ও মেদিনীপুরের ঢাকিরা দিল্লিতে আসতে শুরু করেন।

দিল্লির দুর্গাপূজার প্রারম্ভিক ইতিহাসে গৌর পাল, শম্ভু পাল, অমল চক্রবর্তী, ননী নাথ, সলিল ভট্টাচার্য প্রমুখ প্রতিমাশিল্পীর অবদান অপরিসীম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিস্তার

১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, সরকারি দপ্তরগুলো দিল্লিতে আসতে শুরু করলে দুর্গাপূজার সংখ্যা দ্রুত বাড়ে।

  • করোল বাগ (১৯৪২)
  • লোধি রোড (১৯৪৪)
  • দরিয়াগঞ্জ ও মাতা সুন্দরি রোড (১৯৪৮)
  • বিনয় (সরোজিনী) নগর, মতি বাগ
    এরপর ধীরে ধীরে প্রতিরক্ষা কলোনি, কৈলাশ কলোনি, শাহদরা, তিলক নগর, হৌজখাস, লাজপত নগর, নেতাজি নগর—প্রায় সর্বত্রই পূজা শুরু হয়।

১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে পূজা ছড়িয়ে পড়ে দিল্লির বাইরে—নোয়ডা, ফরিদাবাদ, গুরুগ্রাম, দ্বারকা, ইন্দিরাপুরম পর্যন্ত। ২০১৪ সালের মধ্যে দিল্লি-এনসিআর জুড়ে দুর্গাপূজার সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে যায়।

চিত্তরঞ্জন পার্ক : মিনি বেঙ্গল

দিল্লির দুর্গাপূজার ক্ষেত্রে চিত্তরঞ্জন পার্ক (সি আর পার্ক)-এর কথা আলাদা করে উল্লেখ না করলেই নয়। ১৯৭০ সালে সি-ব্লকে প্রথম পূজা শুরু হয়েছিল। এরপর বিভক্ত হয়ে জে ব্লক, বি ব্লক, মেলা গ্রাউন্ড প্রভৃতি জায়গায় পূজা হতে থাকে।

আজ এই এলাকায় ১২টিরও বেশি বৃহৎ দুর্গাপূজা হয়। এর মধ্যে কালীবাড়ি কমপ্লেক্সের পূজা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পূজার সময় সি আর পার্ক যেন কলকাতার এক টুকরো হয়ে ওঠে—ঢাক, আলোকসজ্জা, খিচুড়ি-ভোগ, আর খাবারের স্টল ভিড় জমায় হাজার হাজার মানুষের।

নতুন সংযোজন

২০২৩ সালে দিল্লির রামকৃষ্ণ মিশনেও দুর্গামূর্তির পূজা শুরু হয়েছে পূর্ণাঙ্গ আচার-অনুষ্ঠান মেনে। এর আগে শুধুমাত্র অষ্টমীতে পট পূজা হতো।

উপসংহার

আজ যখন আমরা দুর্গাপূজার আগমনী সুরে মেতে উঠি, তখন ভুলে যাই না সেই পথিকৃৎ বাঙালিদের, যাঁদের ত্যাগ, শ্রম আর ভক্তি দিল্লির বুকে এই পূজার বীজ রোপণ করেছিল। তাঁদের কারণে আজ রাজধানী শহরও দুর্গাপূজার দিনে বাঙালির আবেগে ভরে ওঠে।

সকল পাঠককে Indrosphere-এর পক্ষ থেকে আন্তরিক দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা।

7 thoughts on “প্রাণের উৎসব রাজধানীতে : দিল্লির দুর্গাপূজার বিস্তার

  1. DN Chakraborty's avatar DN Chakraborty

    কি অপূর্বভাবে তুমি দিল্লির দুর্গাপূজার ইতিহাস তুলে ধরেছ!
    তোমার লেখায় শুধু তথ্য নয়, আবেগ, ঐতিহ্য আর প্রবাসী বাঙালির আত্মিক সংযোগও যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রতিটি অনুচ্ছেদে ইতিহাসের গভীরতা আর সাংস্কৃতিক আবহ এত সুন্দরভাবে মিশেছে, পড়তে পড়তে মনটা ভরে গেল।
    প্রথম পূজার সূচনা থেকে শুরু করে চিত্তরঞ্জন পার্কের বর্তমান জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন পর্যন্ত—তুমি যেভাবে ঘটনাগুলো সাজিয়েছ, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। প্রতিমা, শিল্পী, সংগঠক, আর সাধারণ মানুষের অবদানকে তুমি যেভাবে সম্মান জানিয়েছ, তা লেখার গভীরতা ও সংবেদনশীলতা প্রকাশ করে।
    তোমার লেখনী শুধু তথ্যবহুল নয়, একেবারে হৃদয়স্পর্শী। Indrosphere-এর পক্ষ থেকে এমন একটি সমৃদ্ধ ও আবেগঘন নিবন্ধ উপহার দেওয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে আরও এমন লেখার অপেক্ষায় রইলাম।🙏🏽

    Liked by 1 person

    1. ধন্যবাদ তোমার এত আন্তরিক ও উষ্ণ প্রতিক্রিয়ার জন্য! 😊 তোমার উৎসাহ আমাকে আরও গভীর, হৃদয়স্পর্শী ও ঐতিহ্যনিষ্ঠ লেখা তৈরি করতে প্রেরণা দিচ্ছে। ভবিষ্যতে Indrosphere-এ আরও এমন সমৃদ্ধ নিবন্ধ তোমার সামনে উপস্থাপন করার জন্য আমি অপেক্ষা করছি। 🙏🏽💛

      তুমি থাকলে লেখা সত্যিই আরও অর্থবহ হয়ে ওঠে।

      Like

I'd love to hear your thoughts on this post! Please leave a comment below and let's discuss.