তখন আমি ছিলাম ঝাড়খণ্ড প্রদেশের রাজধানী রাঁচিতে, ব্যাঙ্কের অঞ্চল কার্যালয়ে আমার পোস্টিং ছিলো। মাঝে মাঝে ঝাড়খণ্ড প্রদেশে নানা ব্রাঞ্চে যেতে হতো কর্মের উদ্দেশে। ঝাড়খণ্ডে অনেক অঞ্চল মাওবাদীদের বাস্তবিক কবলে। নিরাপত্তার দৃষ্টিতে আমরা দিনের বেলায় যাতায়াত করতাম। সন্ধ্যা হবার মধ্যে শহরে ঢুকে যেতাম।
ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় ১৪-১৫ বছর আগের। আমাদের সদ্য পদোন্নতি হয়েছে। নতুন পোস্টিং পেতে প্রায় মাস খানেক লাগবে। আমি ও আমার সহকর্মী সঞ্জয়ের ব্যাঙ্কের কাজে দেওঘর যাবার ছিল। দেওঘরে মহাদেবের সুপ্রসিদ্ধ মন্দির আছে — জ্যোতির্লিঙ্গ — বাবাধাম, বৈদ্যনাথ ধাম নামে প্রসিদ্ধ। প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথিতে এই জায়গার নাম ছিল কেতকিবন বা হরিতকিবন। ষোড়শ শতাব্দীতে বৈদ্যনাথ মন্দির নির্মাণের পরে এই জায়গার নাম হয় দেওঘর বা বৈদ্যনাথধাম।
আমাদের পত্নীরা বলল যে তারাও সাথে যাবে। মন্দিরে পূজা দিয়ে আসবে। আমরা কেবল দুজনেই যাচ্ছি, তাই গাড়ীতে যথেষ্ট জায়গা আছে, বাচ্চাদের স্কুলে তখন ছুটি — শীতকালীন অবকাশ চলছে — কোন আপত্তি নেই। ভালোই হবে সপরিবারে একটু excursion হয়ে যাবে — Business-cum-pleasure trip। আমরা যখন কাজে যাবো তখন ওরা নিজেরাই হোটেলে আড্ডা মেরে নেবে, আনন্দ করে নেবে। আমরাও নিশ্চিন্তে আমাদের কাজ করতে পারবো।
আমরা রাঁচি থেকে সকালে তাড়াতাড়ি রওনা হই যাতে সন্ধ্যার পূর্বে আমরা দেওঘর শহরে পৌঁছে যাই। পথে গিরিডি পড়বে, আর গিরিডি জেলার অনেকটা পথ আবার মাওবাদীদের কবলে — লাল অঞ্চল (Red Zone)। এ ছাড়া হাজারীবাগ জেলার মধ্যে কিছু অংশে আছে মাওবাদীদের প্রভাব। দিনের বেলায় সাধারণত বিশেষ ভয়ের কিছু নেই, তবে রাতের অন্ধকারে সে পথে যাওয়া মানে আত্মঘাতী প্রচেষ্টা। মহাদেবের কৃপায় আমরা নির্বিঘ্নে, নিরাপদে সন্ধ্যার পূর্বে দেওঘরে পৌঁছে যাই।
দেওঘরে আমাদের ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের ব্যবস্থাপনায় পরের দিন আমরা বেশ ভালো করে বাবাধামে পূজা করলাম, জলাভিষেক করলাম। বলা বাহুল্য, আমাদের আসল কাজ যার জন্য আসা সেটা ভালভাবেই হোল। এবার ফেরার পালা। সকালে বাচ্চাদের সাথে রওনা হতে সামান্য দেরী হয়ে যায়।
আমরা দেওঘর থেকে গিরিডি পৌঁছাই দুপুরে। গিরিডিতে “বেওকুফ হোটেল” নামে বিখ্যাত ভোজনালয় আছে। আসে পাশে এইরকম নামের আরও কয়েকটি ভোজনালয় খুলে গেছে। এটা একটা ব্র্যান্ড হয়ে গেছে গিরিডিতে। সেই বেওকুফ হোটেলে আমরা আমাদের লাঞ্চ সেরেনি তাড়াতাড়ি করে। দেরিটা মেকআপ করতে হবে। লাঞ্চ করতে করতে আমি আর সঞ্জয় আলোচনা করছিলাম যে সেইদিনটা কি আমরা গিরিডি শহরে থেকে যাবো কিনা। গিরিডি শহরে আমাদের ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ আছে, অসুবিধা কিছুই নেই, ব্যাবস্থা হয়ে যাবে ম্যানেজারকে বললেই। আমি আগে এসেছি গিরিডি শহরে কয়েকবার কাজের সুবাদে। কিন্তু একটাই সমস্যা — গিরিডিতে এমন কোন হোটেল নেই যা নাকি আমাদের পরিবারদের পছন্দ হবে। সরকারি কাজে একদিন দেরি হলে আবার যদি লোকেরা মন্তব্য করে যে এরা দুজনে পরিবার নিয়ে ফুর্তি করছে, তাই দেরিতে ফিরছে — সেই আশঙ্কাও ছিল আমাদের মনে। তাই আমরা নিশ্চয় করলাম এগিয়ে যাই, বাগোদরে পৌঁছে দেখবো কি অবস্থা। যদি সন্ধ্যা হয়ে যায় তাহলে আমরা বরহি হয়ে ঘুরে যাবো। প্রায় দেড় ঘণ্টা বেশী লাগবে তাহলে হাজারীবাগ পৌঁছাতে। বাগোদর জি.টি. রোডের (NH-2) উপর স্থিত।
যখন আমরা জি.টি. রোড পৌঁছাই তখন সূর্যদেব অস্তাচলে। সন্ধ্যা হয়নি। আলোর প্রকাশ মোটামুটি। হাজারীবাগ রোডে দেখলাম গাড়ী ঢুকতে। আধা ঘণ্টার পথ দেড় ঘণ্টা লেগে যাবে ঘুরে যেতে, তাই আমরা ভাবলাম চলো চলে পড়ি, বাড়ী ফেরার তাড়া সব সময় থাকে। কুড়ি মিনিটের মধ্যে বিষ্ণুগড় ছাড়িয়ে যাবো, আর তারপরে অতো চিন্তা নেই। বিষ্ণুগড় একে জঙ্গল এলাকা, তারপরে মাওবাদীদের উপদ্রব। আমরা হাজারীবাগ রোডে বোধ হয় মিনিট পনেরো চলেছি, হটাৎ দেখি সামনে কিছু দূরে গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তার বাঁক, তাই ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ী ঘোরাও। আর পত্নীদের বলা হোল তাদের পার্স গাড়ীর সিটের নীচে লুকিয়ে দিতে, আর সবাই যেন শান্ত থাকে, যাই হউক কোন শব্দ না করে। গলার চেন আর কানের দুল ছাড়া বাকি সব ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে। আমরাও আমাদের পার্সে কিছু টাকা রেখে বাকি ফেলে দিলাম সিটের নীচে। যদি ওরা গাড়ী চেক না করে তবে বেঁচে যাবে, ব্যাগ লুকিয়ে ওদের বোকা বানাবার চেষ্টা করেছি জানলে বহুৎ মার খেতে হবে, জানিনা বাঁচবো কিনা। তবুও ঝুঁকিতো নিতেই হবে।
সরু রাস্তা, জঙ্গলের মধ্যে, গাড়ী একবারে ঘুরবে না। গাড়ী বেঁকাতেই প্রায় ৮-১০ জন লোক, মুখে কাপড় বাঁধা, ঘিরে ফেললো আমাদের গাড়ী আর বলল গাড়ী লাগাতে — সামনের গাড়ীটার পিছনে। ওদের সবার কাছে পিস্তল, বন্দুক, বোমা হাতে। একজন আমার কানের পাশে ধরেছে পিস্তল। আরেকজন সঞ্জয়ের কাছে, তার হাতে গ্রেনেড। এতো কাছে একটা পিস্তলের নল কোনদিন দেখিনি এর আগে। ওদের বললাম আমরা তোমাদের কথা শুনছি, তাই বিচলিত হয়ে ওরা যেন কিছু না করে।
সঞ্জয় বসে ছিল দরজার ঠিক পাশে। আর আমি ছিলাম ড্রাইভার আর সঞ্জয়ের মাঝে। বাকিরা পিছনের সিটে। সঞ্জয়ের ছোট ছেলে ছিল সামনে আমাদের কোলে। আমাদের বলল যা আছে সব বার করে দিতে দিতে। আমরা পার্স খুলে যা টাকা ছিল তা চুপচাপ বার করে দিয়ে দিলাম। হাতের ঘড়ি চাইলো, দিয়েদিলাম। পিছনে ওদের কাছে গয়না চাইলো, ওরা গলার চেন আর কানের দুল খুলে দিয়ে দিলো। কিছু না দিলে যে ওরা আমাদের প্রাণে মেরে ফেলবে। তাই আমরা প্রকাশ্যে অতটুকুই রেখেছিলাম।
আমাদের সামনে আরও কয়েকটি গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে, তাদেরও আমাদের মতো অবস্থা। জঙ্গলে এতক্ষণে বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। জঙ্গলে সন্ধ্যা একটু তাড়াতাড়ি নামে আর যেখানে ডাকাতির ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। বোঝা যাচ্ছে আগে বাস, ট্রাক-ও আটকে আছে। এইবার এলো সবচেয়ে ভয়ের সময়। বলল গাড়ী চেক করবে। আমরা ভাবলাম এবার খেতে হবে ভয়ঙ্কর মার। যে সঞ্জয়ের পাশে গ্রেনেড নিয়ে ছিল, সে বলল নেমে দাঁড়াতে। “সার আপ নিচে আয়িএ, হামকো চেক করনা হ্যায়।” অস্ত্রধারী ডাকাতের কাছে এরকম ভদ্র আচরণ কখনোই আশা করিনি। “স্যার” বলে সম্বোধন করে লুটছে আমাদের! সঞ্জয়কে চেক করতে করতে আমাদের পিছনে আরেকটি গাড়ী এসে দাঁড়াল। আমাদের গাড়ী ছেড়ে ওই গাড়ীর কাছে চলে গেলো। মহাদেবের কৃপায় ছাড় পেয়ে গেলাম! পিছনের গাড়ীটা ছিল হাজারীবাগের বিধায়কের গাড়ী। তার বডিগার্ডের বন্দুকও ওরা ছিনিয়ে নিলো। ২০-২৫ জন অস্ত্রধারির সামনে আর একা কি করবে।
আমরা বসে আছি গাড়ীতে অন্ধকারে প্রায় শ্বাস রুদ্ধকরে। এক এক মিনিট যেন এক এক ঘণ্টা। বাচ্চাদের তো ভয়ে কান্নাও পাচ্ছেনা। দেখি কিছুক্ষণ পরে সব শান্ত, ওই ডাকাতগুলো অন্ধকারে কোথায় মিশে গেলো জঙ্গলের ভিতরে। একটু পরে দেখি পুলিশ জিজ্ঞেস করছে কোথায় গেছে সব? ড্রাইভারকে বললাম চুপ থাকতে, কে জানে এরা পুলিস না পুলিশের বেশে মাওবাদী! পরে দেখি, একটা বিশাল গাছ কেটে ওরা রাস্তার উপরে ফেলে রেখেছে। ঠিক একটা বাঁকের উপর যাতে দূর থেকে না দেখতে পাওয়া যায়। খালি আমরা না, বাসের যাত্রীরাও ছিল। ট্রাকের ড্রাইভার, হেল্পার, বাসের লোকেরা সবাই হাত লাগিয়ে সেই বিশাল গাছটাকে একটু সরিয়ে জায়গা করা হলো যাতে এক-এক করে গাড়ী বেরোতে পারে। পুলিশ বলল ফেরৎ যাও। আমরা বললাম না আমরা সামনেই যাবো, এক রাস্তায় দুইবার ডাকাতি হয় না। কারণ পরের পার্টি কিছুই পাবেনা।
ডাকাতির খবর ছড়িয়ে গেছে রাস্তায়। কিছুটা এগিয়ে দেখি একটা ঢাবায় বাস, গাড়ী কয়েকটি দাঁড়িয়ে আছে, আর লোকেরা চা-নাস্তা খাচ্ছে। অপেক্ষা করছে রাস্তা খালি হবার। এই রাত্রে ডাকাতির জন্য ঢাবার মালিকের বেশ লাভ হয়ে গেলো। কারোর পৌষ মাস তো কারোর সর্বনাশ!
ডাকাতির পরে আমাদের মনে আর ভয় নেই। সর্বহারার আর কিসের ভয়? যা হবার ভয় ছিল সেটা তো হয়েই গেলো। আমরা নিজেদের ব্যাগ, টাকা সামলে তুলে নিলাম। পথে রামগড় পেরিয়ে ওরমাঞ্ঝি বলে একটা জায়গায় মধুবন নামে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে ডিনার করলাম। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে সময় মতো আমরা টাকা লুকিয়ে ফেলেছিলাম। সেখান থেকে বাড়ীতে ফোন করে খবর দেওয়া হয়। বললাম চিন্তার আর কোন কারণ নেই, আমরা ডিনার সেরে বাড়ী ফিরছি। বাড়ী ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে যায়।
এই ঘটনাটা আমার পত্নী জয়ার মনে গভীর ছাপ ফেলে দিয়েছিল। বেশ কয়েক বছর, অন্ধকারে একটু ভয় পেতো, ওর মনে হতো অন্ধকার হলেই, ওরকম মুখ-ঢাকা লোকেরা যেন আশেপাশে ঘুরছে পিস্তল হাতে আর হটাৎ করে সামনে এসে যাবে।

এ তো সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার!! এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। মাওবাদীদের উপদ্রুব একসময় সত্যি সীমা ছাড়িয়ে গেছিল। তবে একটা কথা মনে হয়, ওরা চট্ করে ট্যুরিস্টদের কিছু ক্ষতি করতো না। কারণ, ট্যুরিস্ট আসা একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে ওদের রুজিরোজগার মার খাবে অনেকটা। অবশ্য একসময় প্রায় বন্ধ-ই হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ওই ২০০৫ নাগাদ-ই আমরা ম্যাকলাক্সিগঞ্জ গেছিলাম। রাঁচি থেকে গেছিলাম, তখন-ও দেখেছি ড্রাইভার প্রায় সিঁটিয়ে আছে- এই বুঝি মাওবাদীরা আসে! তবে, যেটা বলার, ম্যাকলাক্সিগঞ্জে আমরা একটা বিশাল বাগান বাড়ীতে ছিলাম। ওখানে নাকি বুদ্ধদেব গুহ-ও থেকে গেছেন কয়েকবার। খুব সুন্দর সাজানোগোছানো। আমরা অনেকে গেছিলাম, প্রায় ঊনিশজনের দল। বাংলো’র সামনে দুটো ঘর, তার একটায় আমরা ছিলাম। বাকীরা পেছনের দিকে। আমি তো রাতে এমনিতেই দেরী করে ঘুমাই, তো জেগে আছি, বই পড়ছি, রাত প্রায় দেড়টা হবে। এমন সময় হঠাৎ মনে হল কেউ বা কারা মোটরবাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে আস্তে আস্তে বাংলোর নুড়িফেলা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে। তখন সবাই ঘুমাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কী, বেশ ভয় পেয়ে গেলেও কৌতূহল-ও হয়েছিল ভীষণ। টেবল ল্যাম্প নিভিয়ে খুব আস্তে জানালা’র পর্দা তুলে দেখি দুটো ছেলে, বাইকে করে এসে নামলো। বাংলো’র কেয়ারটেকার বোধহয় জানতো-ই যে এরা আসবে, সে পেছন দিকে, নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে একটা ছোট প্যাকেট মত দিল, ফিস্ফিস্ করে কিছু কথা হল, তারপর চলে গেল। পরে, কথায় কথায় কেয়ারটেকার ছেলেটি বলেছিল যে, বাংলো ভাড়া হলেই ওরা এসে “হফ্তা” নিয়ে যায় আর কী…।কিন্তু ট্যুরিস্টদের কিছু বলে না।
LikeLiked by 1 person
সেটা সত্যি কথা। সাধারণত ওরা পর্যটক বা “honest officerদের বিরক্ত করেনি। কারখানা, খনি মালিকদের, কনট্রাক্টরদের থেকে “হফতা” নিত। এমনিতে ওরা অনুশাসিত ছিল। কিন্তু কখনো যে পরিস্থিতি বেকাবু হয়নি তাও নয়। আর যারা ডাকাতি করছে তারা যে ক্রিমিনাল নয় সেটা বোঝার কোন উপায় নাই। পরিবার সাথে বলে ভয় বেশী ছিল। অবশেষে it’s all well that ends well.
LikeLiked by 1 person