দাঁতের ডাক্তার

আমাদের রিজনাল ম্যানেজার গোয়েল সাহেব আজকাল খুব খুশ থাকেন। তার গোল, কালো মুখে সাদা দাঁতের ঝিলিক দেওয়া হাসি একটু বেশী দেখা যাচ্ছে আজকাল।  বিকেলে সব বিভাগের ম্যানেজারদের নিজের বাড়ীতে বিয়ার পার্টিতে ডেকেছেন। গোয়েল সাহেব নিজেই বিয়ারের খুব ভক্ত। কিন্তু হটাৎ কেন বিকেলে এতো সদয় হয়ে আমাদেরকে ডেকেছেন, এই নিয়ে লাঞ্চ টাইমে অফিসে বেশ আলোচনা চলেছে।

প্রসাদজী বসের বাড়ী যাওয়া নিয়ে একটু বেশী চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তার দুটো বড়ো সমস্যা — প্রথমে কি উপহার নিয়ে যাবে আর দ্বিতীয় নিজের শ্রীমতীকে নিয়ে যাবে কিনা? এই দুটি ব্যাপারে চিন্তা মাথায় এলে সময় প্রচুর লাগে এবং সাথে সাথে মানসিক টেনশন হয় খুব। বাড়ী পৌঁছে শ্রীমতীকে বোলতেই উনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। “তোমার তো সব সময়ে কাজ আর কাজ। খালি ফাইলের মধ্যে পেন হাতে নিয়ে মাথা গুঁজে বসে থাকো। দেখো, শেখো নিজের বসের থেকে কিছু। আমি মিসেস গোয়েলের কাছ থেকে সব শুনেছি। ওনাদের ছেলে ডেন্টিস্ট হয়ে গেছে। সদ্য পাশ করেছে। সামনের মাসে এখানে আসছে। ছেলে লায়েক হয়ে গেছে, এখন ভালো কতো সম্বন্ধ আসবে। তোমার মতো নাকি? খালি ফাইলেই জীবন শেষ। এছাড়া যেন কোন দুনিয়া নেই।”

আসল ব্যাপারটা বোঝা গেলো সন্ধ্যার সময়ে বসের বাড়ীতে পৌঁছে। বস বিয়ারের গ্লাস সাজিয়ে সবাই দিয়ে যখন ‘চিয়ার্স’ করলেন। “চলো ছেলে আমার ডেন্টিস্ট হয়ে গেছে। এই কালকেই রেজাল্ট বেরিয়েছে, ভালভাবে পাশ করে গেছে। ছোটবেলায় ভীষণ দুরন্ত ছিল, পড়ার থেকে কেবল পালিয়ে বেড়াতো। কতবার যে মার খেয়েছে সেই জন্য। যাক শেষে ডাক্তার হয়ে গেছে। খুব ভালো। সবাই এই খুশীতে এঞ্জয় করো।”

বিয়ার খেতে খেতে গোয়েল সাহেব বললেন “প্রসাদজী কোন ব্রাঞ্চে কথা বলো লোনের জন্য, ছেলেকে একটা ক্লিনিক খুলে দিতে হবে তো। দু-চারটে যন্ত্রপাতি লাগবে, কিছু ফার্নিচার লাগবে। সবশুদ্ধ প্রায় ২৫ লক্ষ টাকার মতো প্রয়োজন পড়বে। তার জন্য লোনের ফাইল তৈরি করো। ছেলের এসে শুরু করতেও তো মাস দুয়েক লেগে যাবে।”

প্রসাদজী উত্তর দিলেন “স্যার, আপনি পুরো রিজিওনের মালিক, আপনার এক ইশারায় ম্যানেজাররা মিনিটের মধ্যে লোন ডিসবার্স করে দেবে। আপনার কিসের চিন্তা? আমি কাল সকালেই মাথুর সাহেবকে ফোন করে দেবো। সে এসে সব দরকারি কাগজপত্র নিয়ে যাবে আর সব হয়ে যাবে। নো প্রব্লেম স্যার, নো প্রব্লেম।”

মাথুর সাহেব আমাদের শহরের মেন ব্রাঞ্চের সিনিয়র ম্যানেজার। বয়স্ক ব্যাক্তি। আর এক বছর আছে তার রিটায়র হতে।  মাথার  চুল সব সাদা হয়ে গিয়েছে। এই শহরেই তার বাড়ী। সেই জন্য ব্যাঙ্ক রিটায়রমেন্টের আগে তাকে এই শহরে পোস্টিং দিয়েছে। পরের দিন প্রসাদজী মাথুর সাহেবকে ফোন করে বড়ো সাহেবের ইচ্ছা জানালেন। মাথুর সাহেব ভাবলেন আর তো এক বছর আছে রিটায়রমেন্টের, লোন দিলে পরে নিজের দাঁত সঙ্ক্রান্ত ব্যাপারে যাওয়া যেতে পারে। বোলতে পারবেন পরে — “বেটা, আমি তোকে লোন দিয়েছি, তুই আমাকে দাঁত দে।”

মাথুর সাহেবের ব্রাঞ্চের পাশেই ক্লিনিক তৈরি হচ্ছিলো। এক মাসের মধ্যে লোন মঞ্জুরি হয়ে গিয়েছে। ক্লিনিক নির্মিত, যন্ত্রপাতি আসলেই শুরু হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে একমাস কেটে গিয়েছে। গোয়েল সাহেবের ছেলে এসে গিয়েছে। ক্লিনিকে ফার্নিচার সব লেগে গিয়েছে। এবং ডাক্তার সাহেব বসতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু যন্ত্রপাতি এখনো আসেনি। আসেনি মানে ডাক্তার সাহেবের ভারতীয় যন্ত্রপাতি পছন্দ হচ্ছে না। ওনার চাই বিদেশী যন্ত্র। তাই এক মার্কিন কোম্পানি থেকে কোটেশন জোগাড় করা হচ্ছে। সময় লাগছে। মাথুর সাহেব দু-একবার জিজ্ঞাসা করেছেন এই ব্যাপারে কিন্তু সঠিক উত্তর পান নি। পরে জিজ্ঞাসা করা ছেড়ে দিয়েছেন, যখন কোটেশন আসবে, বন্ত্রপাতি আয়াত হবে তখন লোনের পেমেন্ট করা হবে।

এরমধ্যে একদিন মাথুর সাহেব বিরিয়ানি খাচ্ছিলেন। হাড়ের এক টুকরো দাঁতের ফাঁকে ফেঁসে গিয়েছে। রবিবারের সন্ধ্যা। আশেপাশে কোন ডাক্তার বসেনা রবিবারে। এদিকে দাঁতের ব্যাথা বেড়ে চলেছে। কিছু ঘরেলু উপায় করা হয়েছে। কিছুতেই লাভ পাচ্ছেন না। ভাবিজী, মানে মাথুর সাহেবের স্ত্রী, আমাদের ফোন করলেন। উনি চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন কি করবেন? আমরা পৌঁছাই রাত্রে মাথুর সাহেবের বাড়ীতে। তখন ১০টা বেজে গিয়েছে। প্রসাদজী বললেন গোয়েল সাহেবের ছেলে তো আছে, তার সাথে একবার কন্সাল্ট করে নিতে। নতুন ডাক্তার হয়ে ফিরেছে। এতো রাত্রে আর কোন উপায় নেই, অগত্যা গোয়েল সাহেবকে ফোন লাগানো হলো। উনি ডেকে দিলেন তার ছেলে কে। ফোনে প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে আলোচনা করার পরে ওষুধের নাম বললেন। মাথুর সাহেবের ছেলে রাত্রে স্কুটার নিয়ে ছুটলো ওষুধ কিনতে। আমরা নিজেদের বাড়ী ফিরে এলাম। পরের দিন সকালে এসে আবার খোঁজ নিয়ে যাবো বলে এলাম।

বাড়ীতে ফিরে এসে ডিনার করে শুতে যাবো তখন আবার ফোন বেজে উঠলো। রাত্রে বারোটা বেজে গিয়েছে। এত রাত্রে ফোন, চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। ফোন তুলতেই মাথুর সাহেবের ছেলে জানালো যে মাথুর সাহেবের শরীর ওই ক্যাপসুল খাবার আধা ঘণ্টার পর থেকেই কেমন অসুস্থ হয়ে গেছে। মুখ ফুলে গিয়েছে, লাল হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম তাহলে তো রাত্রে নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হবে। মনে হচ্ছে ওষুধে reaction হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম যে আমি যাচ্ছি গাড়ী নিয়ে, আমার গাড়ীতেই মাথুর সাহেবকে নার্সিং হোমে নিয়ে যাবো। চিন্তা না করতে, আর মাথুর সাহেব কে দেখতে। নার্সিং হোমের এক ডাক্তারের সাথে আমার পরিচিতি আছে। জয়াকে বললাম আমি যাচ্ছি মাথুর সাহেবকে নিয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি করতে আর জয়া যেন ডাক্তার সাহেবকে ফোন করে জানিয়ে দ্যায় যাতে আমাদের নার্সিং হোমে রাত্রে মাথুর সাহেবকে ভর্তি করতে কোন আসুবিধা না হয়। রাত দুটোর সময় বাড়ী ফিরি মাথুর সাহেবকে নার্সিং হোমে ভর্তি করে।

মাথুর সাহেব দুই দিন নার্সিং হোমে ছিলেন। তৃতীয় দিনে ছাড়া পান। চতুর্থ দিনে ব্রাঞ্চে আসেন কাজ করতে। সকালেই প্রথমে ফোন লাগান প্রসাদজীকে। কিছু কাঁচা ভাষায় গালি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কোন গর্দভ ডেন্টিস্টের ফাইল পাঠিয়েছিলো লোন করার জন্য? দাঁতের ডাক্তার না শালা ঘোড়ার ডাক্তার! ভাগ্যের জোরে বেঁচে গিয়েছেন এবার। রেগে বললেন যে এক পয়সা লোন ডিসবার্স করবেন না এবং ফাইল ফেরৎ পাঠিয়ে দিচ্ছেন। “উস গোলু কে মুঁহ পে মারনা য়ে ফাইল।”

6 thoughts on “দাঁতের ডাক্তার

  1. “বেটা, আমি তোকে লোন দিয়েছি, তুই আমাকে দাঁত দে।” 😀 😀 এটা ব্যাপক!!
    কেমন ডাক্তার হয়েছিল তা অবশ্য বেশ বোঝা যাচ্ছে… 😛

    Liked by 1 person

    1. হ্যাঁ, প্রকৃত ঘটনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। নাম, স্থান এবং প্রকৃত ঘটনা অবশ্যই বাস্তব নয়।

      Like

Leave a reply to Maniparna Sengupta Majumder Cancel reply