সবুজ দ্বীপের রাণী

বারো বছরের মেয়েটা একদিন সকালে আনন্দবাজার কাগজটা হাতে নিয়ে ছুটতে ছুটতে এলো বাবার কাছে। পাতা খুলে উত্তেজিত হয়ে বললো দেখো বাপি সবুজ দ্বীপে জারোয়াদের বাড়ীতে একটা বাচ্চা হয়েছে, এই যে দেখো ছবি! এবার গরমের ছুটিতে আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে? দুর পাগলি ওখানে কি করে যাবি, ওখানে শুধু যারা ওদের নিয়ে রিসার্চ করে তারাই যেতে পারে। রেলের পদস্থ অফিসার বাবা এই বলে কাটিয়ে তো দিলেন কিন্ত স্বপ্নেও ভাবেন নি তার আদরের কন্যাটি মনে মনে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল, বড় হয়ে আমিও এদের নিয়ে রিসার্চ করবো!

শিবপুরের ভাবিনী গার্লস স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে মেয়েটা প্রেসিডেন্সিতে BSc (Hons.) Anthropology, ক্লাসে ভর্তি হলো। বিস্মিত বাবা যখন জিজ্ঞেস করলেন কি হবে এটা পড়ে? মেধাবী কন্যাটি হেসে জবাব দিয়েছিল এটাই আমার সবুজ দ্বীপে যাবার পাসপোর্ট! 

দারুণ রেজাল্ট করে ভর্তি হলো MScতে এবং সেখানেও পেলো ফার্স্ট ক্লাস। এবার মেয়েটি PhD. ফেলোশিপের জন্য দরখাস্ত করলো Anthropological Survey of India (ASI) – তে ফিল্ড রিসার্চের জন্য, বিষয় ঠিক করলো “Genetic Study among the Aborigines of the Andaman“|

দরখাস্ত দেখে তো ডিরেক্টর সাহেবের আক্কেল গুড়ুম! ডাকাবুকো ছেলেরা যেখানে ওইসব দ্বীপে পা রাখতে ভয় পায় সেখানে কিনা যেতে চায় একটা মেয়ে তাও বাঙালী! এককথায় হয়ে গেলো নাকচ, শেষমেষ ওর আগের সব পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে আর ইন্টারভিউ তে সন্তষ্ট হয়ে রাজী হলেন তারা কিন্ত একটি শর্তে — বাড়ীর লোককে লিখে দিতে হবে সেখানে কোন অঘটন ঘটলে ASI দায়ী হবেনা। ততদিনে বাবা বিদায় নিয়েছেন ইহলোক থেকে, বাধ্য হয়ে মুচলেকা দিলেন জন্মদাত্রী মা, ভদ্রমহিলা সেদিন কিন্ত বোঝেন নি মেয়েকে আন্দামানে যেতে দিয়ে এক ইতিহাসের সূচনা করলেন।

পরবর্তী ছবছর মেয়েটা চষে ফেললো আন্দামানের আদিম অধিবাসী অধ্যুষিত বেশ কটা দ্বীপ। এমন বিশ্বাস অর্জন করলো ভয়ংকর জারোয়াদের যে তারা অবলীলায় বাচ্চাদের ছেড়ে দিতো তার হাতে। লিটল আন্দামানের ওঙ্গে উপজাতির লোকজন তাকে দেখলে ঘিরে ধরে নাচতো। স্থানীয় লোকজনের মুখে তার নামই হয়ে গেলো “জঙ্গলী ম্যাডাম”!

কিন্ত তখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে হিংস্র সেন্টিনেলী। 1880 সালে এক বৃটিশ কমান্ডার সশস্ত্র সেনাদল নিয়ে ধরে নিয়ে এসেছিলেন চার শিশুসহ এক সেন্টিনেলী দম্পতিকে। শিশুরা বাঁচলেও সহ্য করতে পারেনি ঐ দম্পতি সভ্যতার বিষ, মারা যাবার পর শিশুদের আবার দ্বীপে ছেড়ে আসা হয়। সত্তর সালে ASI এর বিশেষজ্ঞরা একবার চেষ্টা করেন উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপে নামার কিন্ত কূল থেকে ছুটে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে তীর তাদের সে আশায় জল ঢেলে দিলো। 1974 এ Nat Geo “Man in Search of Man” নামে একটা ডকুমেন্টরী বানানোর উদ্দেশ্য নিয়ে নেমেছিল ওখানে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে বেচারা ফিরিঙ্গী পরিচালকের ঊরুতে আট ফুট লম্বা একটা বর্শা গেঁথে যেতে আর কারো হিম্মত হয়নি সুটিং করার।

অবশেষে এলো সেই দিন, ১৯৯১ সালের চৌঠা জানুয়ারী। MV Tarmugli নামে আন্দামান প্রশাসনের একটা ছোট জাহাজ তেরজন যাত্রীকে নিয়ে রওয়ানা হলো সেন্টিনেল দ্বীপের দিকে, উদ্দেশ্য তাদের সাথে সৌহার্দ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা। এই প্রথম অভিযানে সামিল হলো একটি মেয়ে, ডক্টর মধুমালা চ্যাটার্জী।

দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছে ঊঠলেন তারা ছোট নৌকায় সঙ্গে উপহার দেবার জন্য প্রচুর নারকোল । তটের কাছে পৌছুতেই গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো একদল সেন্টিনেলী, ষাট হাজার বছর ধরে যারা সভ্যতার আলোয় আসেনি। দলে বেশির ভাগই পুরুষ যাদের হাতে তীরধনুক বর্শা, মহিলাদের কোলে শিশুসন্তান।

নৌকা থেকেই ASI টিমের সদস্যরা জলে একটার পর একটা নারকোল ফেলতে লাগলেন। এক বরফ শীতল নীরবতা আর তারপরই বেশ কজন আদিবাসী জলে নেমে নারকোল তুলতে লাগলো। উল্লাসে ফেটে পড়লেন সদস্যরা, অবশেষে সেন্টিনেলীরা সভ্য মানুষের উপহার গ্রহন করেছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মধুমালা নামলেন হাঁটু জলে, দুহাতে নারকোল নিয়ে পাড়ের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ওঙ্গে ভাষায় চীৎকার করলেন, নারিয়েলি জাভা জাভা! এসো তোমরাও নারকোল নিয়ে যাও । 

তটে দাঁড়ানো এক সেন্টিনেলী কখন যে তাকে লক্ষ্য করে ধনুকে তীর জুড়েছে, খেয়াল করেনি কেউই। শেষ মুহুর্তে এক আদিবাসী মহিলা ধনুকধারীকে ধাক্কা দেওয়ায় বেঁচে যান ডক্টর। চার ঘন্টা ধরে চললো এই উপহার পর্ব। বেলা শেষে দেখা গেলো সেন্টিনেলীরা সবাই তাদের অস্ত্র পায়ের কাছে নামিয়ে রেখেছে। অভিজ্ঞ মধুমালা বুঝলেন বরফ গলেছে, ধীর পায়ে হেঁটে উঠলেন সেন্টিনেল দ্বীপের তটভূমিতে। তার হাত থেকে এবার সরাসরি নারকোল নিলো বেশ কজন সেন্টিনেলী। ষাট হাজার বছর পরে এই প্রথম সরাসরি কোন সভ্য মানুষের হাত থেকে উপহার গ্রহন করলো পৃথিবীর আদিমতম এক উপজাতি, আর সেইসাথেই নৃতত্ব বিজ্ঞানের ইতিহাসে জুড়ে গেলো এক নতুন অধ্যায়! 

সফল হলো হাওড়া শিবপুরের বারো বছরের সেই মেয়েটির দেখা স্বপ্ন।

সবুজ দ্বীপের এই মানুষগুলোর টানে হেলায় ছেড়েছেন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় গুলির একাধিক লোভনীয় চাকরী। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের Social justice & Backward class welfare মন্ত্রকের ডেপুটি ডিরেক্টর এবং দিল্লী লক্ষীবাঈ নগরের বাসিন্দা আজকের প্রথমা ডক্টর মধুমালা চ্যাটার্জী।

3 thoughts on “সবুজ দ্বীপের রাণী

  1. ইন্দ্র, তুই কি এইটা ইংরাজিতে translate করেছিস? না করে থাকলে, আমি কি করতে পারি?
    এমন এক অসাধারন বাঙ্গালি মহিলার কথা বিশ্বজনের সমক্ষ্যে রাখতে হলে ইংরাজিতে ছাপতেই হবে।

    Liked by 1 person

Leave a reply to Aranyascope Cancel reply