ভারতের সর্বপ্রথম ডকুমেন্টেড বায়োটেররিজম

১৯৩৩ সালের ২৬শে নভেম্বর…স্থান হাওড়া স্টেশন। কাউন্টার থেকে টিকিট কিনে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে চলেছেন পাকুড় রাজবাড়ির ছোটকুমার অমরেন্দ্রচন্দ্র পান্ডে, সঙ্গে তাঁর বোন রাজকুমারী বনবালা। একটু পিছনে রয়েছেন বড়কুমার বিনয়েন্দ্রচন্দ্র… ছোটভাই এবং বোনকে তিনি এগিয়ে দিতে এসেছেন। প্ল্যাটফর্মের তুমুল ভিড় এবং ধাক্কাধাক্কির মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে ট্রেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।

“উফফ”… চিৎকার করে উঠলেন অমরেন্দ্র! “কি হয়েছে দাদা” বলে ছুটে এলেন বনবালা। অমরেন্দ্র বললেন, “ভিড়ের মধ্যে একটা লোকের সঙ্গে ধাক্কা লাগলো…কি একটা ফুটে গেছে আমার হাতে”। বনবালা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন…ময়লা চাদর গায়ে একটা ভিখারি; সেও একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বনবালাকে। পিছন থেকে এগিয়ে এলেন বিনয়েন্দ্র… “কই দেখি…কি হয়েছে?” সব শুনে বললেন, “জামা খোল, কি ফুটেছে দেখি।” ভিড় থেকে দূরে সরিয়ে জামা খোলানো হলো অমরেন্দ্রকে।

বাম হাতের বাজুতে একটা ছোট্ট ফুটো! এতোটাই ছোট যে রক্তও বেরোয়নি। রক্তের পরিবর্তে সেই ফুটোর মুখে লেগে রয়েছে হালকা হলদে রঙের একটি তরল! সেই তরল জামায় লেগে জামাটাও ভিজে গেছে।” এখনই ডাক্তারের কাছে চলো… আমার ভীষণ ভয় করছে”…বললেন বনবালা। অমরেন্দ্র বললেন, “ধ্যাত… কি একটা লেগেছে… এর জন্য ডাক্তারের কাছে যাবো কি রে!” বিনয়েন্দ্র বললেন, “পাকুড়ে পৌঁছে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিস… সাবধানের মার নেই”।

ট্রেনে উঠে বনবালা বললেন, “দাদা, আমার ভীষণ ভয় করছে। যে লোকটার সঙ্গে তোমার ধাক্কা লাগলো, সেই লোকটাকে আমি আগে দেখেছি। পরশু ভবানীপুরে পূর্ণ সিনেমায় আমরা ছবি দেখতে গিয়েছিলাম… টিকিট কাউন্টারের সামনে ওই লোকটাই ঘুরঘুর করছিল…সেই এক মুখ… এক গায়ের চাদর”। অমরেন্দ্র হেসে বললেন, “এইবারে কিন্তু তুই উল্টোপাল্টা বকছিস”।

ঘণ্টা ছয়েক রেলযাত্রা করে অমরেন্দ্র এবং বনবালা যখন পাকুড় পৌঁছালেন… ততক্ষণে অমরেন্দ্রর হাত ফুলে ঢোল হয়ে গেছে… সঙ্গে ধুম জ্বর! পরদিনই বনবালা এবং অমরেন্দ্রর বন্ধু কমলাপ্রসাদ অমরেন্দ্রকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য পুনরায় কলকাতায় চলে এলেন… দেখা করলেন ডাঃ নলিনীরঞ্জন সেনগুপ্তের সঙ্গে।

অমরেন্দ্রকে পরীক্ষা করবার পরে ডাঃ সেনগুপ্ত বললেন, “অমরেন্দ্র সেপটিসেমিয়ায় ভুগছে”! সেপটিসেমিয়া… অর্থাৎ এমন একটি সংক্রমণ বা ইনফেকশন যা রক্তের মাধ্যমে দ্রুত শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু কোন জীবাণুঘটিত সংক্রমণ? জানবার জন্য অমরেন্দ্রর রক্ত কালচার করতে পাঠালেন ডাঃ সেনগুপ্ত। শুরু হলো চিকিৎসা। কিন্তু ডাঃ সেনগুপ্তের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে, মাত্র কুড়ি বছর বয়সে, স্বল্প রোগভোগের পর ৪ঠা ডিসেম্বর অমরেন্দ্র মারা গেলেন… মুখাগ্নি করলেন দাদা বিনয়েন্দ্র।

অমরেন্দ্র মারা যাওয়ার দুদিন পরে তাঁর রক্তের কালচার রিপোর্ট এলো। কালচার রিপোর্ট দেখে চোখ মাথায় উঠলো ডাঃ সেনগুপ্তের। রিপোর্টে লেখা রয়েছে… “গ্রোথ অফ ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস”! “ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস”… প্লেগের জীবাণু! এলো কোথা থেকে? প্লেগ তো মহামারীর আকারে আসে… কোথায় মহামারী? বিউবোনিক নয়… নিউমোনিক নয়… একেবারে সরাসরি সেপটিসেমিক প্লেগ! এ কি করে সম্ভব?

সন্দেহের বীজ দানা বাঁধলো ডাঃ সেনগুপ্তের মনে। তিনি, বনবালা এবং কমলাপ্রসাদ দেখা করলেন কলকাতার তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ এর সঙ্গে। সব শুনবার পরে ডেপুটি কমিশনার বললেন, “অমরেন্দ্র মারা গেছেন সেপটিসেমিয়ায়… যা স্বাভাবিক মৃত্যু। তাঁকে দাহ করা হয়ে গেছে…সুতরাং ময়নাতদন্ত সম্ভব নয়। এই অবস্থায় আমি কি করতে পারি?” কমিশনারের পা জড়িয়ে ধরলেন বনবালা…”আমার দাদা বড় ভালো ছেলে ছিল হুজুর… দায়িত্ববান ছেলে…আমাদের সকলের খেয়াল রাখতো… মাত্র কুড়ি বছর বয়সে চলে গেল… এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয় হুজুর… এটা খুন… আমি দাদার হয়ে আপনার কাছে বিচার চাইতে এসেছি… দয়া করে একটু সাহায্য করুন”।

মন গললো ডেপুটি কমিশনারের। ডেকে পাঠালেন লালবাজারের দুঁদে গোয়েন্দা অফিসার শরৎচন্দ্র মিত্রকে। বললেন, “শোনো শরৎ, এটা রাজপরিবারের মামলা। সাবধানে তদন্ত করবে। ডিপার্টমেন্ট যেন বদনাম না হয়”। কেবলমাত্র বনবালার সন্দেহ এবং প্লেগের জীবাণু… এইটুকু মাত্র পুঁজি নিয়ে তদন্তে নামলেন শরৎবাবু।

পরদিনই বনবালা এবং ডাঃ সেনগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে শরৎবাবু চলে গেলেন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউএর উপরে অবস্থিত “ক্যালকাটা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন” এ যা ছিল তৎকালীন সময়ে জীবাণুঘটিত রোগসংক্রান্ত ব্যাপারে পৃথিবীর মধ্যে শীর্ষ স্থানাধিকারী… দেখা করলেন সেখানকার ডিরেক্টরের সঙ্গে। প্রশ্ন করলেন, “প্লেগের জীবাণু সরাসরি রক্তে ঢুকে সেপটিসেমিয়া করতে পারে?” উত্তর এলো, “পারে…যদি সেই জীবাণু শরীরের কোনো ঘা বা আলসারের সংস্পর্শে চলে আসে”। শরৎবাবু এবারে বনবালার দিকে ঘুরলেন, “অমরেন্দ্রর শরীরে কোনো ঘা ছিলো?” বনবালা উত্তর দিলেন, “না তো… ও হ্যাঁ… হাওড়া স্টেশনে একটা লোকের সঙ্গে দাদার ধাক্কা লেগে হাতে কি একটা ফুটে যায়… ঘা বলতে ব্যাস ওইটুকুই”। ডাঃ সেনগুপ্ত বললেন, “হ্যাঁ…আমিও সেটা দেখেছি… বাম হাতের বাজুতে ছোট্ট একটা ফুটো… ইনজেকশন দিলে যেমন ফুটো হয়… অনেকটা সেইরকম”।

পুনরায় ডিরেক্টরের দিকে ঘুরলেন শরৎবাবু, “প্লেগের জীবাণু শরীরের মধ্যে ইনজেকশন দিলে কি তার সেপটিসেমিক প্লেগ হতে পারে?” ভুরু কোঁচকালেন ডিরেক্টর…বললেন, “হওয়া তো উচিত…কিন্তু এমন উদ্ভট ঘটনার কথা শুনিনি কখনও!” আবার প্রশ্ন, “এই মুহূর্তে ভারতের কোথাও কি প্লেগের মহামারী চলছে?” উত্তর, “না, তেমন কোনো খবর নেই। তেমন হলে আমার কাছে খবর থাকতো।”

ট্রপিক্যাল থেকে বেরিয়ে এসে শরৎবাবু বনবালাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হাওড়া স্টেশনে এবং পূর্ণ সিনেমায় গায়ে ময়লা চাদর জড়ানো যে লোকটাকে দেখেছিলেন, তার চেহারার বর্ণনা দিতে পারবেন?” সম্মতি পেয়ে বনবালাকে নিয়ে সটান লালবাজার চলে এলেন শরৎবাবু… ডেকে পাঠালেন পুলিশের চিত্রশিল্পীকে। বনবালার বর্ণনা মতো সেই লোকটির মুখের ছবি আঁকিয়ে আটকানো হলো কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়… কাজে লাগানো হলো পুলিশের খবরিদের। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। বেশ কিছুদিন লেগে থাকার পরেও সেই লোকটির কোনো সন্ধান বার করতে পারলো না লালবাজার।

শরৎবাবু হাল ছাড়লেন না। তিনি পুনরায় দেখা করলেন “ক্যালকাটা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন” এর ডিরেক্টরের সঙ্গে। এবারে তাঁর প্রশ্ন, “প্লেগ রোগীর দেহ ছাড়া প্লেগের জীবাণু আর কোথায় পাওয়া যায়?” উত্তর এলো, “বম্বের হাফকিন ইনস্টিটিউটে প্লেগের ওষুধ এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কার করবার কাজ চলছে। সেখানে গবেষণার জন্য প্লেগের জীবাণু সংরক্ষিত আছে।”

পরদিনই বম্বের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন শরৎবাবু…দেখা করলেন হাফকিন ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরের সঙ্গে। প্রশ্ন, “প্লেগের জীবাণু কোথায় রাখা আছে? সেগুলোর সিকিউরিটি কে দেখে? জীবাণুর সমস্ত ভায়াল ঠিকঠাক আছে নাকি কিছু খোয়া গেছে?” ডিরেক্টর জানান, “সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। অমন মারক জীবাণুর সিকিউরিটি অত্যন্ত কড়া… খোয়া যাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই।”

বেরিয়ে আসার মুহূর্তে শরৎবাবুকে আটকালেন ডিরেক্টর। বললেন, “এক মিনিট…একটা কথা মনে পড়লো। বেঙ্গল থেকে ট্রপিক্যাল মেডিসিনের একজন ডিপ্লোমা হোল্ডার নিজের গবেষণার জন্য প্লেগের কিছু জীবাণু চাইতে এসেছিলেন। কিন্তু এই মারক জীবাণু যার তার হাতে দেওয়া যায় না… সরকারী আধিকারিকের অনুমতিপত্র লাগে। তাঁকে সেকথা জানানোর পরে তিনি চলে যান। কিছুদিন পরে দুজন ডাক্তারের রেফারেন্স লেটার নিয়ে ফিরে আসেন… তবে তাঁরা কেউই সরকারী আধিকারিক ছিলেন না। আমার সন্দেহ হয়… তাই আমি সেই ব্যাক্তির হাতে প্লেগের জীবাণু তুলে দিইনি। মনে হলো কথাটা আপনাকে জানানো দরকার।”একমুখ হাসি নিয়ে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন শরৎবাবু। বললেন, “অ্যাপ্লিকেশনের ফাইল দেখে এই তিনটে লোকের নাম ঠিকানা বার করুন… এখনই।”

ফাইল এলো, নাম ঠিকানা বার হলো। ডিপ্লোমা হোল্ডারটির নাম ডাঃ তারানাথ ভট্টাচার্য্য। রেফারেন্স লেটার যারা দিয়েছিলেন, তাঁদের নাম ডাঃ দুর্গারতন ধর এবং ডাঃ শিবপদ ভট্টাচার্য্য… তিনজনেরই বাড়ি পাকুড়ে! কলকাতায় ফিরে এলেন শরৎবাবু। পুনরায় খবরিদের কাজে লাগালেন। দেখা গেল, তারানাথ হলেন পাকুড় রাজপরিবারের চিকিৎসক। তিনি আদপে পাশ করা ডাক্তার নন…হাতুড়ে ডাক্তার…কলকাতার কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের একটি ল্যাবরেটরিতে কিছুদিন ব্যাকটেরিওলজিস্ট এর কাজ করেছিলেন। অপরদিকে দুর্গারতন এবং শিবপদ…দুজনেই পাকুড়ের নাম করা চিকিৎসক।

ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশের সঙ্গে দেখা করলেন শরৎবাবু। বললেন, “অপরাধীদের পেয়ে গেছি স্যার… এই তিনজনের নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট চাই।” পরদিনই পাকুড় থেকে গ্রেপ্তার হলেন তারানাথ, শিবপদ এবং দুর্গারতন। জেরার মুখে তারানাথ জানালেন, “আমি প্লেগের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলাম। সেই ওষুধের কার্যকারিতা জানার জন্য প্লেগের জীবাণু আমার দরকার ছিলো…তাই হাফকিন ইনস্টিটিউটে চাইতে গিয়েছিলাম… কিন্তু ওরা আমায় দেয়নি”। অপরদিকে শিবপদ এবং দুর্গারতন দুজনেই একবাক্যে বলেন, “তারানাথ আমাদের বলেছিল যে ও প্লেগের ওষুধ আবিষ্কার করেছে। সেই ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য প্লেগের যে জীবাণুর প্রয়োজন, তা পেতে গেলে আমাদের রেফারেন্স লেটার লাগবে…তাই আমরা সেই চিঠি দিয়েছি। কি অন্যায় করেছি আমরা?”

অকাট্য যুক্তি! সত্যিই তো দুর্গারতন এবং শিবপদর কোনো দোষ নেই…খুনের মোটিভও নেই। তারানাথের একটা হালকা মোটিভ রয়েছে ঠিকই…কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে চেষ্টা করলেও প্লেগের জীবাণু শেষ অবধি সে হাতে পায়নি। কিন্তু অমরেন্দ্রর মৃত্যু হয়েছে প্লেগে এবং তাঁরই পারিবারিক চিকিৎসকের দাবী এই যে তিনি প্লেগের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন… এটা কি নিছকই সমাপতন? নাকি এর পিছনে রয়েছে আরও অনেক বড় চক্রান্ত?

অঙ্ক মেলাতে শুরু করলেন শরৎবাবু। অমরেন্দ্রর মৃত্যু হয়েছে প্লেগে। এদিকে ভারতে কোথাও প্লেগের মহামারী চলছে না। সুতরাং কোনো ল্যাবরেটরি থেকেই অমরেন্দ্রর শরীরে ঢোকা প্লেগের জীবাণু হাতসাফাই করে হাসিল করা হয়েছিল… এটা অনস্বীকার্য। ক্যালকাটা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ডিরেক্টরের মতে ভারতের মধ্যে প্লেগের জীবাণু বম্বের হাফকিন ইনস্টিটিউট ছাড়া আর কোথাও নেই। সুতরাং প্লেগের জীবাণু এসেছে হাফকিন ইনস্টিটিউট থেকেই। কিন্তু হাফকিন ইনস্টিটিউট তারানাথকে সেই জীবাণু দেয়নি। তাহলে প্লেগের জীবাণু হাফকিন ইনস্টিটিউট থেকে বেরোলো কোন পথে?

পুনরায় বম্বে ছুটলেন শরৎবাবু। হাফকিন ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরের ঘরে ঢুকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা প্লেগের জীবাণু কয়েক মাসের মধ্যে গবেষণার উদ্দেশ্যে আর কোনো ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়েছেন?” উত্তর এলো, “আর্থার রোড ইনফেকশস ডিজিজ হাসপাতাল থেকে কয়েকমাস আগে প্লেগ ব্যাসিলাস চেয়ে পাঠিয়ে ছিলো। আমরা কিছু ব্যাসিলাস সেখানে পাঠিয়ে ছিলাম।”

সেখান থেকেই ট্যাক্সি ধরলেন শরৎবাবু… গন্তব্য… আর্থার রোড ইনফেকশস ডিজিজ হাসপাতাল। সেখানকার আধিকারিক ডাঃ মেহতা এবং ডাঃ প্যাটেলের সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা হাফকিন ইনস্টিটিউট থেকে যে প্লেগের জীবাণু আনিয়ে ছিলেন… সেগুলো কোথায়?” তাঁরা উত্তর দিলেন, “সেগুলো তো ইঁদুরের উপর প্রয়োগ করা হয়ে গেছে”। প্রশ্ন, “কে প্রয়োগ করেছে?” উত্তর এলো, “বেঙ্গল থেকে একটা ছেলে এখানে গবেষণা করছিল…বলেছিল যে সে প্লেগের ওষুধ আবিষ্কার করেছে…ইঁদুরের উপর প্লেগের সংক্রমণ ঘটিয়ে তাদের উপর নিজের আবিষ্কার করা ওষুধ প্রয়োগ করে সেই ওষুধের কার্যকারিতা সে প্রমাণ করতে চায়। তার কথামতো আমরা হাফকিন ইনস্টিটিউট থেকে প্লেগ ব্যাসিলাস আনিয়ে ছিলাম। সেই ছেলেটি ইঁদুরের উপর প্রথমে প্লেগ ব্যাসিলাস প্রয়োগ করে…তারপরে নিজের তৈরী করা ওষুধ প্রয়োগ করে। কিন্তু ওষুধে কাজ হয়নি… সবকটা ইঁদুর মারা যায়। কিন্তু গবেষণার সম্পূর্ণ ফলাফল জানার আগের দিনই পারিবারিক অসুবিধার কারণ দেখিয়ে সে এই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায়।”

শরৎবাবু প্রশ্ন করলেন, “প্লেগের সমস্ত জীবাণু সে প্রয়োগ করেছিল নাকি কিছুটা বাঁচিয়ে রেখেছিল…জানেন আপনারা?” উত্তর এলো, “এই ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না”। তারানাথের ছবি বার করে ডাঃ প্যাটেল এবং ডাঃ মেহতাকে দেখান শরৎবাবু… “এই ছেলেটাই তো?” সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন ডাঃ প্যাটেল এবং ডাঃ মেহতা!

ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ডাঃ মেহতা এবং ডাঃ প্যাটেলকে জিজ্ঞাসা করেন, “একটা অপরিচিত ছেলে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে আপনাদের কাছে এসে মারক ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করতে চাইলো এবং আপনারা তার ব্যাকগ্রাউন্ড না জেনে সেটা করতে দিলেন? এই দায়িত্ববোধ আপনাদের?” ডাঃ প্যাটেল বললেন, “বিশ্বাস করুন অফিসার…আমাদের কোনো দোষ নেই। ছেলেটা একজন প্রভাবশালী ব্যাক্তির চিঠি নিয়ে এসেছিল… সেইজন্য আমরা তাকে কাজ দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।” ভুরু কুঁচকে গেল শরৎবাবুর। “প্রভাবশালী ব্যাক্তি! কে সে?” ফাইলের স্তূপ ঘেটে সন্ধান পাওয়া গেলো সেই “প্রভাবশালী ব্যাক্তি”র। চিঠির নীচের সইটা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন শরৎবাবু। তারানাথকে রেকমেন্ড করে চিঠি লিখেছিলেন যে প্রভাবশালী ব্যাক্তি… তাঁর নাম বিনয়েন্দ্রচন্দ্র পান্ডে…খুন হয়ে যাওয়া অমরেন্দ্রর সৎ দাদা… পাকুড় রাজবাড়ির বড়কুমার! ডাঃ প্যাটেলের অফিস থেকেই ফোন গেল লালবাজার ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশের অফিসে… “আরেকটা ওয়ারেন্ট চাই স্যার… কিংপিনের সন্ধান পেয়ে গেছি… মোটিভও পরিষ্কার।”

পরদিনই গ্রেপ্তার হলেন বিনয়েন্দ্রচন্দ্র। জেরার মুখে পড়ে স্বীকার করলেন সমস্ত অপরাধ। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া মাত্রই জমিদারির অংশ দাবী করেন অমরেন্দ্র। মদ, জুয়া, বাইজিতে আসক্ত বিনয়েন্দ্র তাতে রাজি ছিলেন না… ঠিক করেন ভাইকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে…সমস্ত সম্পত্তি একাই ভোগ করবেন। সেই মতো প্ল্যান ছকেন…সঙ্গী জোটান তারানাথকে। এমন এক হাতিয়ার যা অপ্রচলিত… প্রচলিত চিকিৎসা শাস্ত্রে যে মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে মনে হয়… সেই জৈব অস্ত্রের (বায়োলজিকাল ওয়েপন) সাহারা নেন বিনয়েন্দ্র এবং তারানাথ। প্লেগ জীবাণুর কথা তারানাথেরই মাথায় আসে…কারণ প্লেগের কোনো চিকিৎসা নেই…মারণাস্ত্র হিসাবে অব্যর্থ!

প্ল্যান মতো হাফকিন ইনস্টিটিউট থেকে ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ডিপ্লোমা হোল্ডার পরিচয় দিয়ে প্লেগ ব্যাসিলাস হাতসাফাই করতে ব্যার্থ হন তারানাথ। অল্টারনেটিভ প্ল্যানিং অনুযায়ী আর্থার রোড হাসপাতালে রিসার্চ ফেলো হিসাবে ঢুকে প্লেগ জীবাণু হস্তগত করেন। সেই জীবাণু কিছুটা ইঁদুরের দেহে প্রয়োগ করেন…কিছু ইঁদুরের মৃত্যু দেখে জীবাণুর মারণক্ষমতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হন…বাকিটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জে ভরে চলে আসেন কলকাতা। পূর্ণ সিনেমায় বিনয়েন্দ্র ভাড়াটে খুনীকে নিয়ে এসে দূর থেকে অমরেন্দ্রকে চিনিয়ে দেন। সেই ভাড়াটে খুনীর মাধ্যমেই হাওড়া স্টেশনে ধাক্কাধাক্কির সময়ে সেই প্লেগ জীবাণু ইনজেক্ট করেন অমরেন্দ্রর শরীরে। ফল… দশ দিনের মধ্যে অমরেন্দ্রর মৃত্যু!

কলকাতা হাইকোর্টে এই মামলার বিচার চলে। লালবাজার অত্যন্ত তাড়াতাড়ি চার্জশীট দাখিল করে এবং পাবলিক প্রসিকিউটর অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে সওয়াল করেন। প্রকৃত খুনী অর্থাৎ ময়লা চাদর গায়ে দেওয়া সেই লোকটিকে লালবাজার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও খুঁজে পায়নি। “কাহানি” সিনেমার মিলন দামজির মতোই সেই লোকটিও গায়েব হয়ে যায়। খুনের হাতিয়ার অর্থাৎ সেই প্লেগ ব্যাসিলাস ভরা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জটি পাওয়া না গেলেও এবং সেই ভাড়াটে খুনীকে ধরা সম্ভব না হলেও পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে কলকাতা হাইকোর্ট এই মামলাকে “বিরলের মধ্যে বিরলতম” আখ্যা দিয়ে তারানাথ এবং বিনয়েন্দ্রকে ফাঁসির সাজা শোনায়। যদিও পরে প্রিভি কাউন্সিলে সাজার পরিমাণ কমিয়ে তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিণত করে। দুর্গারতন এবং শিবপদকে বেকসুর খালাস করা হয়।

আজকাল “জৈব অস্ত্র”, “বায়োটেররিজম”, “বায়োলজিকাল ওয়ারফেয়ার” কথাগুলির সঙ্গে আমরা অত্যন্ত পরিচিত। মিডিয়ার দৌলতে আমরা অ্যানথ্রাক্স, এম ডি আর টিবি, এইচ আই ভি, জিকা, নিপা, ইবোলা, সার্স-কোভ-২, এই নামগুলোর সঙ্গেও পরিচিত…আমরা জানি যে এই জীবাণুগুলি এতোটাই মারাত্মক যে এর প্রয়োগে মানবসভ্যতা ক্রাইসিসের মধ্যে পড়ে যেতে পারে। যদি আমি ভুল না করি, তবে মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথম ডকুমেন্টেড জৈব অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটেছিল এই বাঙলার মাটিতে… হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে… এই হত্যার ঘটনাটিতে… ক্ষমা করবেন যদি আমি ভুল হই।

8 thoughts on “ভারতের সর্বপ্রথম ডকুমেন্টেড বায়োটেররিজম

  1. শ্রুতিলিপি গল্প পাঠ's avatar শ্রুতিলিপি গল্প পাঠ

    আপনার এই ঘটনা বিবরণটি আমরা গল্পের আকারে উপস্থাপন করতে চাই। আপনার অনুমতি প্রার্থনীয়

    Like

      1. শ্রুতিলিপি গল্প পাঠ's avatar শ্রুতিলিপি গল্প পাঠ

        অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার যোগাযোগ সূত্রটি পেলে লিংক দিতে আরেকটু সুবিধে হতো।

        Liked by 1 person

  2. শ্রুতিলিপি গল্প পাঠ's avatar শ্রুতিলিপি গল্প পাঠ

    জানেন কি একসময়ে লালবাজার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এর গোয়েন্দাদেরকেও হার মানাতো! রহস্যময় এক খুনের জট কিভাবে খুলে ফেলেছিলেন তৎকালীন লালবাজারের দুঁদে গোয়েন্দা সেটা জানতে হলে শুনতে হবে শ্রুতিলিপির এই গল্পটি। লিখেছেন ইন্দ্রজিৎ রায় চৌধুরী।

    Liked by 1 person

Leave a reply to Pranoy Biswas Cancel reply