রাঁচির ঐতিহাসিক ইউনিয়ন ক্লাব ও লাইব্রেরী

১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৭শে নভেম্বরে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার (Bengal Presidency) অন্যতম পাহাড়-জঙ্গল-নদী-ঝর্ণায় সমৃদ্ধ ছোটনাগপুর উপত্যকার ছোট্ট শহর রাঁচীতে কয়েকজন শিক্ষিত বাংলাভাষী মিলে শহরের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী কে এন রায়ের মেন রোডের ব্যবসা দপ্তরের একটি ঘরে স্থাপনা করেছিলেন পাবলিক লাইব্রেরী।

নিয়মিত বই, ম্যাগাজিন আর সংবাদপত্র পাঠের জন্য তাঁরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় একত্রিত হতেন এবং সামজিক মেলামেশার মাধ্যমে বন্ধুত্বের নিবিড় বন্ধনে নিজেদের আবদ্ধ করে আনন্দে বাঁচতেন।

সেই শতাব্দীর শেষদিকে বাংলাভাষীদের আরও তিনটি ক্লাব স্থাপিত হয়েছিল: টাউন ক্লাব, ছোটনাগপুর ক্লাব, ও ইউনিয়ন ক্লাব। সেইসময়ের বাংলাভাষীরা একসাথে আনন্দে ও দুঃখে একে অন্যের পাশে থাকতে জানতেন। তাই ১৮৮৬ তে পাবলিক লাইব্রেরী, ছোটনাগপুর ক্লাব, টাউন ক্লাব, আর ইউনিয়ন ক্লাব একসাথে মিলে গিয়ে গঠিত হয়েছিল ইউনিয়ন ক্লাব ও লাইব্রেরী। তাই নতুন ক্লাবের লোগোতে লেখা হয়েছিল “সংগচ্ছধ্বম” — যা আজও আছে।

বিগত ১৯০০ শতকে শহরের থাড়পাখনা অঞ্চলের সেন্ট অ্যান্না স্কুলের পিছনে একটি বাড়ী কিনে একসাথে ৪টি ক্লাবের মিলন হয়েছিল। ১৯৩৯ এ হাজারীবাগ রোডে নতুন ক্লাবের বাড়িটার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন রাঁচির কমিশনার মিডলটন সাহেব। হাজারীবাগ রোডের বিশাল ক্লাবভবন ১৫৭ বছর ধরে  অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় নবকুমার রায় মহাশয় ১৯০৩ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত পাবলিক লাইব্রেরীর সভাপতি ছিলেন। বাবু নবকুমার রায়ের পরে ক্লাবের সভাপতি হয়েছিলেন সেই আমলের ছোটনাগপুরের ডাকসাইটে এক্সাইস কমিশনার বাবু সারদাচরণ আয়কত। তাঁদের পরিবারকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাঁকূড়া জিলার বিষ্ণুপুর থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাঁচিতে এনেছিলেন। রাঁচির দুর্গাবাটি মন্দিরের পাশের গলিটা ওনার নামেই এখনও আছে – সারদাবাবু স্ট্রীট।

সারদাবাবুর পরে ক্লাবের সভাপতি হয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ভূগর্ভবিজ্ঞানী বাবু প্রমথনাথ বোস। প্রমথনাথ বোসের দেখানো দিশায় স্যার জামশেদজী টাটা “সিংভূমের কালীমাটি” গ্রামে “টাটা ষ্টীল কোম্পানী” শুরু করেছিলেন। আজও জামশেদপুরে প্রমথনাথ বোসের মর্মরমূর্তি সসম্মানে অবস্থান করছে।

১৯১১ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত দীর্ঘসময়ের সুদক্ষ সভাপতি ছিলেন রায়বাহাদুর রাধাগোবিন্দ চৌধুরী। ১৯১২তে রাঁচি নবগঠিত “বিহার” রাজ্যের গ্রীষ্মের রাজধানী রুপে চিহ্নিত হয়েছিল।

১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দল থেকে পদত্যাগ করে ভারতের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস রাঁচিতে রাজনৈতিক সফরে এসে আয়কত পরিবরের লালপুর অঞ্চলের বাড়ীতেই আতিথ্য গ্রহন করেছিলেন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নতুনদাদা ও বাংলার নবজাগরন ও স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিয়মিত পদধূলিতে এই ক্লাব সমৃদ্ধ হয়েছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে রাঁচিতে টেগোর হীল এর শান্তিধামে নিয়মিত বসবাস শুরু করেন। জ্যোতিরিন্দ্র্যনাথ ঠাকুর যখন হাতেটানা রিক্সায় চড়ে ইউনিয়ন ক্লাব ও পাবলিক লাইব্রেরীর পুরানো যৌথ মালিকানার ছোট্ট বাড়ীটায় আসতেন তখন ক্লাবের রাস্তাটি ইউনিয়ন ক্লাব লেন নামে পরিচিত ছিল। এখন ওই রাস্তাটির নাম রাধাগোবিন্দ স্ট্রীট। সেইসময়কার সভাপতি রায়বাহাদুর রাধাগোবিন্দ চৌধুরী ও রায়বাহাদুর নবকুমার রাযের উদ্যোগে জ্যোতিরিন্দ্র্যনাথ ঠাকুর সাহিত্যসভা ও নাটকের মহড়াতে নিয়মিত নির্দেশনায় থাকতেন ।

ক্লাবে ১৮৬৪তে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সময় থেকে ১৯১২তে বিহার এবং ২০০০ এ ঝাড়খন্ড রাজ্যর স্থাপনায় বারেবারে উৎসবে মেতে উঠেছেন শহরের বাংলাভাষীরা। এখনও খেলাধূলা, সমাজসেবা, বাংলা সাহিত্য,  বাংলা সংস্কৃতি, লাইব্রেরী ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতচর্চার প্রধান কেন্দ্র রাঁচির এই ইউনিয়ন ক্লাব ও লাইব্রেরী।

এই ইউনিয়ন ক্লাব ও লাইব্রেরীর ইতিহাস জানিয়েছেন রাঁচির প্রসিদ্ধ বঙ্গ সংস্কৃতিপ্রেমী শ্রী সুবীর লাহিড়ী মহাশয়।

2 thoughts on “রাঁচির ঐতিহাসিক ইউনিয়ন ক্লাব ও লাইব্রেরী

I'd love to hear your thoughts on this post! Please leave a comment below and let's discuss.