বাঙ্গালীর ফলাহার

আমার এক স্কুলের সহপাঠী উজ্জ্বলের লেখা পড়ে ভাবলাম আমি আজ একটু খাওয়া দাওয়া নিয়ে আলোচনা করি, সাথে ওর লেখা শেয়ার করি। আমার মতে ভারতে অন্তত বাঙ্গালীদের মত ভোজন রসিক জাত আর কেউ নেই।

আমার অবাঙ্গালী বন্ধুরা এই অব্দি পড়ে হয়ত রে রে করে উঠবেন এই বলে যে, “তুই ব্যাটা নিজে বাঙ্গালী বলে নিজের জাতের হয়ে কথা বলছিস।” তাদের আমি সম্মান সহকারে বলবো, “ধীরে, বন্ধু ধীরে! একথাটা আমি এমনি এমনি বলছি না। বলছি অভিজ্ঞতা থেকে। চাকরি সূত্রে সমগ্র ভারত ঘুরতে হয়েছে। অল্প স্বল্প বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও আছে। কোন নতুন যায়গায় গেলে সেখানের স্থানীয় খাদ্যাভাস সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেওয়া আমার অভ্যাস। নেহাতই বাঙ্গালীর খাদ্যাভাস নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে সেভাবে লেখালেখি হয়নি যেভাবে ফরাসী বা চিনা খাবার নিয়ে হয়েছে। নাহলে বাঙ্গালীর খাদ্যাভাস পৃথিবীতে এক নম্বর হতো।”

বাঙ্গালীর খাদ্যভাসের প্রথম গুণ হল এর ব্যাপকতা। আমিষ নিরামিষ মিষ্টান্ন সবকিছুই বাঙ্গালী অতি উতসাহের সাথে খেয়ে থাকে। বাঙ্গালীর আরেকটা গুণ হল বাঙ্গালী সব রকম খাদ্যকেই আপন করে নিতে পারে।

বাঙ্গালী মাছের ঝোল যেমন খায়, তেমন ভালবেসে বিরিয়ানিও খায়, চাউমিনও খায়, মোমোও খায়, বার্গারও খায়। বাঙ্গালী মাটন চিকেন যেমন খায় তেমন কাঁকড়া কচ্ছপও খায় (এখন কচ্ছপ মারা বলবো বেআইনি)। ফল মূল অবশ্য সাধারণ ভাবে বাঙ্গালীরা অতটা ভালবাসে না। কিন্তু তাও কিছুটা খায়।

এছাড়া একই খাবার বিভিন্ন ভাবে রান্না করতে বাঙ্গালীর জুড়ি নেই। সাধারণ মাছের ঝোলও যদি দশজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে রান্না করানো যায় তাহলে প্রতিক্ষেত্রেই তার স্বাদ আলাদা আলাদা হবে। সাধারণ ভাবে বাঙ্গালীরা রান্নার কোন স্ট্যান্ডার্ড ফরমুলা ব্যবহার করেন না।

ভারতে এখনও বাঙ্গালীরাই নিজেদের রোজগারের সব থেকে বেশি অংশ ব্যয় করে খাওয়া দাওয়ার পেছনে।

আজ বাঙ্গালীদের ফলাহার  খাওয়া নিয়ে কিছু বলছি। একসময় বাঙ্গালী ব্রাহ্মণরা কোন অব্রাহ্মণের বাড়ি থেকে ব্রাহ্মণ ভোজনের নিমন্ত্রণ পেলে, সেখানে অন্ন গ্রহণ করতেন না। অন্নের বদলে ফলাহার  গ্রহণ করতেন। কিছু ধর্মীয় উৎসব যেমন – মহাশিবরাত্রি বা জন্মাষ্টমী তে উপবাস করলে, শুধু ব্রাহ্মণরাই নন, অব্রাহ্মণরাও ফলাহার  গ্রহণ করতেন।

ফলাহার  বাংলার একটি প্রাচীন এবং বহুলপ্রচলিত খাদ্যাভাস। একসাথে ফল ও আহার অথবা ফলমিশ্রিত আহারকে বলা হয় ফলাহার, যার চলিতরূপ হল ফলার। ভাত ছাড়া অন্যান্য নিরামিষ পদযুক্ত আহারকেই একভাবে  ফলাহার বলা যেতে পারে।

ফলাহারে নিরামিষ পদের মধ্যে সাধারণতঃ লুচি, চিঁড়ে, দই, মিষ্টি ও ফলকেই গণ্য করা হয়। গোড়ায় ফলাহার  বলতে খুব মিহি সরু চিঁড়ে ও মুড়কি, তার সাথে দই, চিনি, ক্ষীর এবং পাকা আম, কাঁঠাল, কলা প্রভৃতি ফল সহযোগে যে খাবার উৎসব-অনুষ্ঠান উপলক্ষে পরিবেশিত হত, তাকেই বোঝাত।

ফলাহার  ঠিক কতদিনের প্রাচীন তা বলা কঠিন, তবে মধ্যযুগীয় বাংলায় এই খাবারটির বেশ প্রচলন ছিল। বৈষ্ণবদের মহোৎসবে প্রচলিত প্রসিদ্ধ ‘চিঁড়াভোগ’ এই ফলারেরই আরেকরূপ।

ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে পানিহাটিতে নিত্যানন্দপ্রভুর আগমন উপলক্ষে ভক্ত রঘুনাথদাস বিখ্যাত চিঁড়া – দধি মহোৎসব আয়োজন করেন। সেই উৎসবে প্রচুর পরিমাণ চিঁড়ে, দই, দুধ, সন্দেশ ও কলা ভক্তদের মধ্যে পরিবেশিত হয়েছিল।

এর কিছুকাল পরে নরোত্তমদাস-আয়োজিত খেতুরীর প্রসিদ্ধ মহোৎসবেও চিঁড়ে-দই পরিবেশন করার কথা জানা যায়। বৈষ্ণব মহোৎসবে মাটির সরা বা মালসায় এই খাবারটি অগণিত ভক্তদের মধ্যে বিলানো হত। এখনও বৈষ্ণবদের উৎসবে ফলারের বেশ চলন আছে। তবে জাতিভেদ প্রথা শিথিল হবার সাথে সাথে ফলারের প্রচলন অনেকটাই কমে গেছে।

‘কবিকঙ্কণ-চণ্ডী’-তে নিদয়ার সাধে খাবারের তালিকায় ‘চিঁড়া চাঁপাকলা দুধের সর’ এবং ভালো ‘মহিষা-দই’, খই, চিনি ও পাকা চাঁপাকলা মিশ্রিত ফলারের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেকালে দুপুরের খাবারের আগে বাড়ির মহিলারা স্নান করে সকালে ‘খণ্ড, কলা, চিঁড়া ও দই খেতেন। প্রাতরাশের জন্যে সেকালে ‘খণ্ড’, চিনি, চাঁপাকলার বহুল ব্যবহার ছিল।

স্নান করি দুর্বলা খায় দধি খণ্ড কলা
চিঁড়া দই দেয় ভারি জনে।

 কবিকঙ্কণ-চণ্ডী

আঠারো শতকের শেষার্ধের কবি অকিঞ্চন চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে লহনা কর্তৃক খুল্লনাকে আপ্যায়ণ করে ‘জলপান’-এর জন্যে এই দ্রব্যগুলি প্রদানের উল্লেখ আছে।

ফলাহার কে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যে নদীয়া-কৃষ্ণনগরের কিছু ভূমিকা ছিল বলে জানা যায়। শোনা যায়, এই অঞ্চলের এক গোয়ালা কোন সময় তদানীন্তন নদীয়া রাজকে কলা পাতায় করে খুব মিহি চিঁড়ে, অতি সুস্বাদু ক্ষীর, দই, কলা ও অন্যান্য ফল দিয়ে এমন অ্যাপ্যায়িত করেছিলেন যে, রাজাও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন।

সময়ের সাথে সাথে প্রাচীন বাংলার এই উত্তম ও সরস খাদ্যটির তালিকায় যুক্ত হয় লুচি, কচুরি, মিঠাইমণ্ডা প্রভৃতি। এর ফলে ফলাহার, কাঁচা ফলাহার ওপাকা ফলাহার, এই দুই শ্রেণীতে ভাগ হয়ে যায়। চিঁড়ে, দই, মিষ্টি ও ফল সহযোগে যে ফলাহার  তাকে কাঁচা ফলাহার  বলে। পাকা ফলারে লুচি থাকে। সাধারণতঃ লুচির সাথে ছানা ও চিনিকে পাকা ফলাহার  বলা হয়। অবশ্য ছানাও বাঙ্গালীদের মধ্যে সহজে গ্রহণযোগ্য হয়নি। কেননা ছানার প্রচলন করেছিল বিদেশিরা

বাংলায়  ছানার আবির্ভাব পর্তুগিজদের হাত ধরে৷ ষোড়শ শতকে পর্তুগিজরা ভারতে প্রথমবার পা ফেলল এবং তাদের সঙ্গেই ছানা চলে এল ৷

পশ্চিমবঙ্গের ব্যান্ডেল অঞ্চলে তারা তাদের ঘাঁটি গড়ে তোলার পর শুরু হল ছানার যাত্রা৷ পর্তুগিজরা মূলত ৩ রকম চিজ তৈরি করত৷ তার মধ্যে “কটেজ চিজ” ছিল ছানার আদি প্রকার৷ এছাড়াও “ব্যান্ডেল চিজ” যা বার্মার (বর্তমানে মায়ানমার) রাঁধুনিদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল পর্তুগিজদের তত্ত্বাবধানে এবং “ঢাকাই পনির”৷ ব্যান্ডেল চিজ কিন্তু আজও সমান জনপ্রিয় এবং কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন নিউ মার্কেট অঞ্চলেও পাওয়া যায়৷ উপমহাদেশে ছানা তৈরির শিক্ষাবিস্তার অনেক পরের ঘটনা৷ এমনকী প্রথম দিকে ছানা ও ছানার মিষ্টি একরকম পরিত্যাজ্যই ছিল ধর্মীয় কারণে।

১২৬১ বঙ্গাব্দে লেখা পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’ নাটকে, উত্তম, মধ্যম ও অধম— এই তিন প্রকার ফলারের বর্ণনা আছে, তা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক৷পড়ে দেখুন৷ভাল লাগবে৷

উত্তম ফলাহার

ঘিয়ে ভাজা তপ্ত লুচি
দুচারি আদার কুচি
কচুরি তাহাতে খান দুই৷
ছক্কা আর শাক ভাজা
মতিচুর বোঁদে খাজা
আহারের জোগাড় বড়ই৷
নিখুঁতি জিলিপি গজা
ছানাবড়া বড় মজা
শুনে শকশক করে নোলা৷
হরেক রকম মণ্ডা
যদি দেয় গণ্ডা গণ্ডা
যত খাই তত হয় তোলা৷
খুরি খুরি ক্ষীর তায়
চাহিলে অধিক পায়
কাতরি কাটিয়া শুকো দই৷
অনন্তর বাম হাতে
দক্ষিণা পানের সাথে
উত্তম ফলাহার  তারে কই৷

মধ্যম ফলাহার

সরু চিঁড়ে শুকো দই
মর্তমান ও ফাঁকা খই
খাসা মণ্ডা পাত পোরা হয়৷
বৈদিক ব্রাহ্মণ তবে
মধ্যম ফলাহার  কবে
দক্ষিণাটা ইহাতেও রয়৷

অধম ফলাহার

গুমো চিঁড়ে জলো দই
তেতো গুড় ধেনো খই
পেট ভরা তাও নাহি হয়৷
রৌদ্দুরেতে মাথা ফাটে
হাত দিয়ে পাত চাটে
অধম ফলাহার  তারে কয়৷

তথ্যসূত্রঃ

  • সংসদ বাংলা অভিধান – শৈলেন্দ্র বিশ্বাস
  • বাংলার খাবার – প্রণব রায়
  • কবিকঙ্কণ চণ্ডী, কুলীন কুল সর্বস্ব
  • পঞ্চতন্ত্র – সৈয়দ মুজতবা আলি
  • চলন্তিকা – রাজশেখর বসু
  • নেট ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

2 thoughts on “বাঙ্গালীর ফলাহার

I'd love to hear your thoughts on this post! Please leave a comment below and let's discuss.