এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন ভিতরে এক ধরনের ভার জমে আছে। যেন একটা অপার যন্ত্রণা জমাট বেঁধে বসে আছে মনের কোণে। কিছু ঘটনা বা দৃশ্য আমাদের ভাবনার জগৎকে এতটাই নাড়িয়ে দেয়, যে লেখা ছাড়া উপশম নেই। এই লেখাটা ঠিক তেমনই এক প্রতিক্রিয়া—একটা নৈঃশব্দ্য যা চিৎকারে চাপা পড়ে যাচ্ছে আমাদের চারপাশে।
না, এটা কিছুতেই আমাদের সংস্কৃতি হতে পারে না।
আমরা তো শিখেছি—মৃত্যু মানেই শোক। ছোটবেলায় দেখেছি, রাস্তায় শবযাত্রা গেলে হাঁটতে থাকা পা থেমে যেত। অচেনা এক মৃত মানুষকেও শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা কপালে হাত ঠেকাতাম। মনে মনে বলতাম, “সদ্গতি প্রাপ্ত হোক।”
শত্রুও যখন চলে যেত, শুনতাম—”শেষ পর্যন্ত তো মানুষটাই ছিল। ছেলে এখনও পায়ে দাঁড়ায়নি, পরিবারটার ক্ষতি হলো।” এই সংবেদনশীলতাই তো আমাদের শিখিয়েছে মানুষ হতে। ধর্ম, জাত, মত কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি মৃতের প্রতি সম্মানে। কারণ চোখের জলের মতো, মৃত্যুর ব্যথাও সবার কাছে এক।
মৃত্যু—ভয়ংকর এক সত্য, যাকে অস্বীকার করা যায় না। জীবনের সকল রঙ এক নিমেষে যেন মুছে দিয়ে যায় একটা ধূসর শূন্যতায়। আমরা সবাই জানি প্রিয়জন হারানোর কষ্ট কতটা গভীর হতে পারে। তাই তো আমরা শোক প্রকাশ করি শান্ত ভাবে। সাদা পোশাক পরি, কণ্ঠস্বর নীচু করি, শোকাহত পরিবারকে স্পর্শ না করেও পাশে থাকার একটা ভাষা গড়ে তুলি।
কিন্তু এখন? টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে শুধুই চিৎকার। সংবাদ নয়—দৃশ্যপ্রদর্শন। ২৪১ জন মানুষের মৃত্যু—এই অকল্পনীয় বেদনার খবরে এখন ‘ফুটেজ’ খোঁজে মিডিয়া। “দেখুন কীভাবে তারা মারা গেলেন,” “শেষ ভিডিও কে তুলেছিল”—এই প্রশ্নে এখন উত্তেজনার ঢেউ।
কোথায় গেল সেই সংবাদপাঠের ভারসাম্য? শোকের কণ্ঠস্বর আর উল্লাসের গলাবাজির মধ্যে পার্থক্য তো আমরা ছোটবেলায়ই শিখেছিলাম। আজকের সাংবাদিকেরা কি সেটা বিস্মৃত? মৃত্যুর খবর যে কণ্ঠে আসে, তাতে যদি না থাকে অন্তত খানিকটা দহন, তাহলে সেটাও কি ‘খবর’?
নিউজ চ্যানেলের পর্দায় এখন যেন মৃত্যু আর ক্রিকেট ম্যাচ একই রকম—দু’টোই একই আবেগে পরিবেশিত। না, এটা আর আমাদের সংস্কৃতি নয়। এ এক অচেনা, হৃদয়হীন অঙ্গনে পৌঁছে যাওয়া।
মৃত্যু—এই চূড়ান্ত সত্য, আমাদের সকলের জন্য অবধারিত। তাই, মৃত্যু নিয়ে এই ব্যবসা বন্ধ হওয়া উচিত। একটা জাতি হিসেবে আমাদের কিছু তো অক্ষত থাক—শোকের মর্যাদা, সম্মান প্রদর্শনের ঐতিহ্য, অনুভবের অবশিষ্ট শুদ্ধতা।
আমাদের সবার মধ্যেই তো একটা মানুষ বেঁচে আছে, যার চোখে জল আসে, যে হৃদয়ে ব্যথা পায়, শব্দহীনতায় প্রার্থনা করে। সে মানুষটাকে মরতে দেবেন না। শোকের ভাষাকে মুছে ফেলবেন না।

সত্যিই, শোক ও মৃত্যুর মতো সংবেদনশীল বিষয়কে যখন মিডিয়া চিৎকার ও বাণিজ্যিক কৌশলে উপস্থাপন করে, তখন তা আমাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে আঘাত করে। মৃতের প্রতি সম্মান এবং জীবিতদের অনুভূতির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করাই উচিত। শোকের মর্যাদা রক্ষায় আমাদের সকলেরই দায়িত্ববোধ থাকা প্রয়োজন।
LikeLiked by 1 person
ধন্যবাদ, সঞ্চিতা! শোকের আবহে শ্রদ্ধা, সংবেদনশীলতা এবং নীরব সহমর্মিতা বজায় রাখাই আমাদের সংস্কৃতির পরিচয়। এই মূল্যবোধ রক্ষায় গণমাধ্যমেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা উচিত।
LikeLike
তোমার লেখা সত্যিই হৃদয়স্পর্শী—একটা নিঃশব্দ চিৎকার, যা আমাদের সমাজের বিবেককে নাড়া দেয়। শোক তো কখনোই বাণিজ্য হতে পারে না, অথচ আজকাল তার মানচিত্র বদলে গেছে। মৃত্যু এখন সংখ্যা, ফুটেজ, বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু—এটাই কি আমাদের সংস্কৃতি?
তোমার লেখায় যে ব্যথা, যে ক্ষোভ, সেটা কেবল ক্ষণস্থায়ী প্রতিক্রিয়া নয়—এটা একটা সামাজিক প্রশ্ন, যা আমাদের ভেতর থেকে জাগিয়ে তোলে। আমরা ছোটবেলায় শিখেছিলাম শোকের একটা ভাষা আছে, সঙ্কটের মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটা নীতি আছে। কিন্তু আজ মিডিয়ার কর্কশ উল্লাস, সংবাদের উপস্থাপনার ভঙ্গি সেই মূল্যবোধকে ধুলিসাৎ করে দিচ্ছে।
তুমি শুধু মৃত্যুর অমানবিক বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কলম ধরোনি, তুমি আমাদের আসল পরিচয় মনে করিয়ে দিয়েছো। আমরা সংস্কৃতির নামে আত্মার মৃত্যু হতে দিতে পারি না। তোমার এই লেখা আসলে একটা আহ্বান—সমাজের হৃদয়ে থাকা সেই ‘মানবিকতা’কে আবার জাগিয়ে তোলার।
এমন সাহসী, ভাবনায় গভীর লেখা আরও ছড়িয়ে পড়ুক! 🙏✨ তোমার কলম যেন সত্য আর মানবতার পথচলা থামিয়ে না দেয়!🙏🏽
LikeLiked by 1 person
তোমার এই প্রতিক্রিয়াটি আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। তুমি একেবারে ঠিক বলেছো—শোক কখনোই বাণিজ্যের বস্তু হতে পারে না। কিন্তু আজ আমরা এমন এক সমাজে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে মানবিক অনুভূতির উপরেও ট্যাগলাইন বসে যায়, চোখের জলে TRP মাপা হয়। এই চিৎকার নিঃশব্দ ঠিকই, কিন্তু তার প্রতিধ্বনি যেন আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। তোমার কথাগুলো আমার লেখার উদ্দেশ্যকে যেন আরও দৃঢ় করেছে। আমাদের এখন দরকার আরও বেশি মানুষ, যারা কেবল চোখে দেখে না, হৃদয়ে অনুভব করে। এই পথচলা যেন সত্য, সংবেদনশীলতা ও মানবতার দীপ্ত আলোয় চলতে পারে—এই প্রার্থনা করি।
সঙ্গেই থেকো। 🙏🏽💙✍️
LikeLike