অডিটে কুকুর!

মাথুর সাহেব আমাদের মেন ব্রাঞ্চের সিনিয়র ম্যানেজার, প্রবীণ ব্যক্তি, দীর্ঘ তিন দশকের চাকুরী জীবনে অনেক অডিট দেখেছেন। তবুও অডিট এবং অডিটরদের প্রতি একটা আশঙ্কা মনে সব সময় থাকে। ব্যাঙ্কে অডিটের সীমা নেই আর নেই অডিটরদের। বিভিন্ন নামে তারা বিভিন্ন সময়ে চলে আসে। কেউ আসে সময় মতো, কেউ বা আসে খবর দিয়ে আর কেউ তো হটাৎ করে উদয় হয় — Internal Auditor, Statutory Auditor, Annual Auditor, Concurrent Auditor, Stock Auditor, Snap Auditor, Credit Auditor…

যে রকম অডিটরদের বিভিন্ন রূপ, সেরকম আছে তাদের রিপোর্ট। সেও তাদের মতো রকমারি — Branch Audit Report, Monthly Report, Quarterly Report, Half-yearly Report, Annual Report, Credit Audit Report, Stock Audit Report, Statutory Audit Report, Tax Audit Report…

মাথুর সাহেবতো আমাদের বলেন পৃথিবীর ২/৩ ভাগ জলের তলে আর বাকি ১/৩ অডিটের!  আপনারা হয়তো জানেন যে অডিটরদের একটা প্রিয় স্লোগান আছে — “In God we trust, rest all we audit.” আমাদের ব্যাঙ্কের ম্যানেজমেন্ট আবার আরেক কাঠি বাড়া।  তারা এই স্লোগানটিকে আরও জোরদার করে দিয়েছে — “In God and auditor we trust, all officers are suspect and need to be audited.” ম্যানেজমেন্ট ভাবে যে এই অডিট আর অডিটর ছাড়া ব্যাঙ্ক এবং দেশটা বোধহয় গোল্লায় চলে যাবে।

আমাদের টাকলা রিজনাল ম্যানেজার — গোয়েল সাহেব — আবার অডিটরদের প্রতি সবসময় উদারচিত্ত। তিনি তাদের নিজের অফিসে ডাকেন, মীটিং করেন, থাকা-খাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা আছে কিনা সেই সব সুনিশ্চিত করেন। সাথে সাথে অবশ্য সব ম্যানেজারদের জানিয়েদেন অডিটের গুরুত্ব — সময়মত অডিট সমাপন, পুরানো বছরের রিপোর্ট, ইত্যাদি।

গেলো বছরে যে অডিট করতে এসেছিলো মেন ব্রাঞ্চে সে আবার বিলিতি মদের সৌখিন। কথায় কথায় প্রকাশ হয়ে যায়। মাথুর সাহেব ইশারা করে লোন ম্যানেজার — সাক্সেনাজীকে জানিয়ে দেন। সাক্সেনাজী ধুরন্ধর ম্যানেজার। ইশারা পাওয়া মাত্র কাজে লেগে যান। আমাদের কিছু লোনের পার্টিদের কাছ থেকে কয়েকটি সিঙ্গল মল্ট স্কচের বোতল জোগাড় করে আনে। সেই অডিটরকে আমরা দ্বিতীয় দিন থেকে আর ব্রাঞ্চে দেখিনি। সাক্সেনাজী কেবল ফাইল নিয়ে যেতো আর আসতো। পুরো অডিট হোটেলের রুমেই সারা হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, মেন ব্রাঞ্চের রিপোর্টটা খুব ভালো আসে গেলো বছর।

কিন্তু এই বছর যে অডিটর আসছে, সে নাকি খুব কড়া অডিটর। গোয়েল সাহেব তাই আগের থেকেই মাথুর সাহেবকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। ব্যাঙ্কে অডিট মানে ঋণ বিভাগের উপর চাপ। মাথুর সাহেব সাক্সেনাজীকে নিজের ঘরে ডেকে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আলোচনা করলেন আর কিছু বিশেষ নির্দেশ দিলেন। আলোচনার ব্যাপারে  আমরা বিস্তারিত কিছুই জানলাম না, কেবল বুঝলাম অডিট সঙ্ক্রান্ত আলোচনা।

পরের দিন অডিটর সাহেব এলেন তার সাঙ্গপাঙ্গ নয়ে। বেশ গুরুগম্ভীর ভাব। চেহারায় ও হাবভাবে মনে হচ্ছে যেন উনি যুদ্ধ ফতে করতে এসেছেন। মাথুর সাহেবের সাথে এসে কিছু আলোচনা করে, চা-সিঙ্গারা খেয়ে শুরু হয়ে গেলেন। প্রথমেই তলব হোল গেলো বছরের রিপোর্ট। তারপর এই রেজিস্টার, সেই ফাইল। সাক্সেনাজী এবার একটু বেশী অসুবিধায় আছে মনে হচ্ছে। অডিটর সাহেব সব কিছু খুঁটিয়ে-নাটিয়ে দেখছেন। সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে, সবাই আমরা তটস্থ। সাড়ে সাতটার নাগাদ দেখি অডিটর সাহেব তার দলের ছেলেদের ডেকে কিছু বললেন। মুখের কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন বিশেষ ত্রুটি-ভ্রান্তি ধরা পড়েছে। আমরা সাক্সেনাজীর কাছে গেলাম। কিন্তু সাক্সেনাজীকে তেমন চিন্তিত দেখলাম না। আমাদের কেমন আশ্চর্য লাগলো।

দ্বিতীয় দিনে দেখি অডিটর সাহেব অনেক কিছু নোটিং করছেন। যখন যেরকম কাগজ, ফাইল, ভাউচার যা চাইছে সাক্সেনাজী দৌড়ে দৌড়ে নিয়ে আসছে। তৃতীয় দিনে দুপুরে অডিটর সাহেব তার দল বল নিয়ে চলে যান। বিকেলে সব কাজ শেষ হবার পরে মাথুর সাহেব আমাদের ডাকলেন নিজের কেবিনে। গোপালজীকে ডেকে বললেন তিন দিন ধরে সবাই খুব খেটেছে, যাও সিঙ্গারা, জিলিপি নিয়ে এসো। আর ক্যান্টিনে পানুকে বলে দিতে সবার জন্য স্পেশাল চা করতে। গোপালজী আমাদের ব্রাঞ্চের এক পিওন।

মাথুর সাহেব সবাইকে সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ দিলেন এবং তারপরে এদিক-ওদিক ঠাট্টা ইয়ার্কি চলছিলো। কিন্তু আমাদের মনে একটু উত্তেজনা হচ্ছে যে মাথুর সাহেব কেন চিন্তা করছেন না, এবার তো অডিট রিপোর্ট বেশ খারাপ আসবে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের এক সহকর্মী শর্মাজী শেষে মাথুর সাহেবকে প্রশ্ন করেই বসলো। মাথুর সাহেব একটু মুচকি হেসে বললেন “যে যতক্ষণে চা-নাশ্তা আসছে তোমাদের একটা গল্প শোনাই।”

একটু ভূমিকা। ব্যাঙ্কে কর্মচারীদের ইউনিয়নের সাথে ব্যাঙ্ক ম্যানেজমেন্টের একটা বোঝাপড়া আছে  যাকে Bipartite Settlement বলা হয়। কর্মচারী সঙ্ক্রান্ত বিষয় ওই settlement অনুযায়ী নিশ্চিত করা হয়। কর্মচারীরা প্রতি দুইবছর অন্তরালে ভারতে সপরিবারে পরিভ্রমণের জন্য টিকেট ভাড়া পায় একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব অব্দি। তাকে এলেফসি (LFC) — Leave Fare Concession বলা হয়। নিয়ম অনুযায়ী যাত্রার টিকেট অরিজিনাল জমা করতে হবে। কোন টিকেট না থাকলে তাহলে সেই খরচার পরিশোধ হবে না।

এবার গল্পে আসা যাক। এক ব্যাঙ্কের এক ক্লার্ক — নাম শ্যামল বোস একবার সপরিবারে এলেফসি নিয়ে যায় কোলকাতা থেকে চেন্নাই। ঘুরে এসে বোস দাদা TA (Travel Allowance) বিল জমা করে এবং খরচার পরিশোধ দাবী করে। কিন্তু দাদা পরিবারের সদস্যের মধ্যে তার এক পোষা কুকুরের নাম যোগ করেছেন। এলেফসির TA বিল পাশ হয়ে রিজনাল অফিস থেকে। রিজনাল অফিস বিল পাশ করতে মানা করে দ্যায়, বলে যে Bipartite Settlement-এ বাড়ির পোষা জন্তুর কোন প্রাবধান নেই। বোস দাদা উত্তর দিলো যে ব্যাঙ্কের এরকম কোন নিয়ম নেই যে কর্মচারী কুকুর পুষতে পারবেনা। আর আমরা পরিবারের সকলে যদি বাড়ি ছেড়ে পনেরো দিনের জন্য বাইরে যাই, তবে ওই কুকুরটা কোথায় থাকবে? অতএব তার দাবী সমর্থনযোগ্য। বোস দাদা ইউনিয়নকে জানালো তার যুক্তি। ইউনিয়নের আর কি, ইস্যু পেলেই হোল। নেতারা লেগে পড়লো। রিজনাল ম্যানেজার অগত্যা কেসটা হেড অফিস অগ্রসারিত করে দিলেন।

হেড অফিসে বড়ো বড়ো নেতারা জেনেরাল ম্যানেজারের সাথে এই নিয়ে মীটিং করলো। জেনেরাল ম্যানেজার বলেদিলেন ইস্যুটা সমর্থনযোগ্য কি না সেটা বিচারের বিষয় না, কুকুরের খরচা settlement অনযায়ী মোটেই ন্যায়সঙ্গত নয়, অতএব বোস দাদাকে বল কুকুরের খরচা সরিয়ে দিয়ে বাকি খরচার পরিশোধ গ্রহণ করে নিতে। আর হেড অফিস থেকে রিজনাল ম্যানেজারকে বলে দেওয়া হচ্ছে যে কুকুরের জন্য খরচার টাকাটা কেটে নিয়ে বাকি বিল পাশ করে দিতে। নেতারাও জানে যে settlement-এর বাইরে যাওয়া যাবেনা আর একটা সামান্য কুকুরের খরচা নিয়ে বেশী জল ঘোলা করার কোন বিশেষ মানে হয় না। তাই তারা বোস দাদাকে জানিয়ে দিলেন। বোস দাদা অবশেষে বললেন “ঠিক আছে, তাই হউক। বিলের থেকে কুকুরের জন্য দাবী করা টাকাটা কেটে নিয়ে, বাকি টাকাটা পাশ করে দেওয়া হউক।” রিজনাল ম্যানেজার খুশী হয়ে তাড়াতাড়ি সেই ভাবে বিল পাশ করে দিলেন। ভাবলেন ব্যাপারটা তাহলে নিষ্পত্তি হল।

পরে বোস দাদাকে জিজ্ঞাসা করা হল যদি কুকুরের জন্য খরচার টাকাটা ছাড়ার ছিল তবে কেন এতো হাঙ্গামা করলো। বোস দাদা তখন বলল “আমার কিছু টিকেট রাস্তায় হারিয়ে গিয়েছে। আমি টিকেট প্রস্তুত না করলে খরচার পরিশোধ পাবনা তাই কুকুরের নাম যোগ করে দিয়েছি। সবাই কুকুরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শেষে কুকুরের খরচাটা কেটে বাকি টাকাটা পাশ করে দিয়েছে।  তখন আর চেক করেনি টিকেট আছে কিনা।”

মাথুর সাহেব বললেন এইরকম একটা কুকুর সাক্সেনাজী অডিটরকে দেখিয়ে দিয়েছে। অডিটর এখন সেই কুকুরের পিছনে আছে। ভাবছে একটা কিছু পাওয়া গিয়েছে। এই খুশিতে সে বাকি জিনিস অগ্রাহ্য করে গিয়েছে। আর সেই কুকুরের ব্যাপারটা গোয়েল সাহেব ভালো করে জানেন এবং এর রিপর্টিং মাথুর সাহেব আগেই হেড অফিসে করে দিয়েছেন।  তাই সেই নিয়ে চিন্তা করার কোন কারণ নেই।

আমরা সকলে চা-নাশ্তা করে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে এলাম। পরে বুঝলাম অডিটর আসার আগে মাথুর সাহেব আর সাক্সেনাজী মিলে ওই কুকুরের ফন্দি করছিলেন।

3 thoughts on “অডিটে কুকুর!

Leave a reply to Indrajit Roy Choudhury Cancel reply